শনিবার ● ৭ ডিসেম্বর ২০১৯
প্রথম পাতা » বিজ্ঞান সংবাদ: প্রত্নতত্ত্ব » বিজ্ঞানীরা ১২০ লক্ষ বছরের পুরানো সোজা হয়ে হাঁটা নরবানরের ফসিল আবিষ্কার করেছেন
বিজ্ঞানীরা ১২০ লক্ষ বছরের পুরানো সোজা হয়ে হাঁটা নরবানরের ফসিল আবিষ্কার করেছেন
জার্মানির বাভারিয়ায় মানুষ এবং নরবানর সদৃশ আমাদের পূর্ব পুরুষদের মধ্যে একটি ‘মিসিং লিঙ্ক’ আবিষ্কৃত হয়েছে, যারা প্রায় ১২০ লক্ষ বছর পূর্বে বাস করত। গবেষকদের মতে, এই অদ্ভুত প্রাণীটির গাছে ঝুলে থাকার জন্য হাত থাকলেও আমাদের মতো পা ছিল - যা মানুষ ও নরবানরের একক সত্তার ধারণার জন্ম দেয়।
এই আবিষ্কারের মাধ্যমে নরবানর এবং মানুষের সর্বশেষ সাধারণ পূর্বপুরুষ কীরকম দেখতে ছিল তার ধারণা পাওয়া সম্ভব হয়েছে - যা এই সময়কালের জীবাশ্মগুলির মধ্যে বিরল। সেল্টিক নদী দেবতার নামানুসারে এই চওড়া ছাতিওয়ালা প্রাইমেটদের দানুভিয়াস গুগেনমোসি নামকরণ করা হয়েছে, ফলে আমরা এতোদিন দু পায়ে হাঁটা শুরু করার যে সময় সম্পর্কে জানতাম সেই ধারণাও অনেক পূর্বে এই পূর্বপুরুষেরা হাঁটা শুরু করেছিলো। গবেষণা প্রবন্ধটি বিজ্ঞান জার্ণাল নেচারে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে।
দানুভিয়াসের হাড়ের আকৃতির ভিত্তিতে বিশেষজ্ঞরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে প্রাণীটি একটি অনন্য উপায়ে ঘুরে বেড়াত, ধারণা করা হয় আরোহনের জন্য এদের বর্ধিত অঙ্গ ছিল। তারা এই কৌশলটি গাছের শাখা-থেকে-শাখায় ঝুলে বেড়ানো এবং মাটিতে হাঁটা উভয়ের সংমিশ্রণ হিসাবে বর্ণনা করেছেন। দানুভিয়াস প্রায় সাড়ে তিন ফুট লম্বা ছিল এবং ওজন ৩১ কেজি পর্যন্ত ছিল।
এটি একটি হারানো যোগসূত্র। মানুষের মতো নির্দিষ্ট হাড়গুলি কীভাবে একই রকম তা উপলব্ধি করা আমাদের জন্য অবাক করার মতো বিষয় ছিল, ‘বলেছেন জার্মানির ত্যাবিনজেন ইউনিভার্সিটির গবেষণা প্রবন্ধের লেখক এবং জীবাশ্মবিদ ম্যাডেলাইন বোহমে। দানুভিয়াসের পেছনের এবং জঙ্ঘাস্থির হাড়গুলোর সাদৃশ্যের ব্যাপকতা আমাকে বিস্মিত করেছে। এটি আমাদের সবার কাছে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ছিল। দানুভিয়াস হচ্ছে নরবানর এবং মানুষ সদৃশ কোন একক সত্তা।
নরবানর সদৃশ বৈশিষ্ট্যগুলি যেমন সামান্য দীর্ঘায়িত বাহু - বনোবসের (পিগমি শিম্পাঞ্জি) মতো তবে গরিলা বা গিবনের মতো নয় এবং পায়ের বড়ো আঙ্গুল। তবে এর কনুইয়ের গাঁট বড়ো নরবানরের মতো মাপের নয় এবং মানুষ ও ছোট নরবানরের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। এরা বাহু দিয়ে শাখা থেকে ঝুলতে সক্ষম হত।
গিবন বা ওরাংওটাংয়ের মতো নরবানরেরা চলাচলের জন্য পায়ের খুব একটা ব্যবহার করে না, যতোটা না তারা ঝুলে চলাচলের জন্য হাতের ব্যবহার করে। কিন্তু এই প্রজাতিটির পেছনের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছিল সোজা, যার সাহায্যে তারা হাঁটতে পারত। এই নরবানরটির আঁকড়ে ধরার মতো বড় আঙ্গুল ছিল, যার অর্থ এটি পায়ে চলতে পারত।
ডানুভিয়াসের দাঁত থেকে ধারণা করা হয় এরা বিলুপ্ত নরবানর ড্রায়োপিথেসিনস গোত্রের, যারা মধ্য থেকে শেষ মায়োসিন যুগে বিচরণ করত।
মানুষ সহ দুইপায়ে চলা সমস্ত প্রাণীর মতোই নরবানরদের বিস্তৃত বুক, দীর্ঘ মেরুদণ্ড এবং প্রসারিত নিতম্ব এবং হাঁটু থাকতে হবে। এর দেহাবশেষগুলি অলগাউ নামে একটি পার্বত্য অঞ্চলে খনন করা হয়েছিল, যা বর্তমান সময়ে পর্যটকদের কাছে রূপকথার গল্পে বর্ণিত দুর্গের মতো স্থাপনার জন্য জনপ্রিয়।
খননে প্রাপ্ত হাড়গুলি কমপক্ষে চারজনের শরীরের - একজন পুরুষ, দুইজন মহিলা ও একটি কিশোর এবং কেবল দাঁতই নয়, মাথার খুলি, চোয়াল, পাঁজর খাঁচা এবং মেরুদণ্ডের পাশাপাশি হাত, পা, আঙুল এবং পায়ের হাড়ের অংশও পাওয়া গিয়েছে।
প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের কঙ্কালটি এতটাই পরিপূর্ণ ছিল যে গবেষকরা এর অঙ্গ এবং দেহের অনুপাতের বিশদ বর্ণনা করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
এটি আধুনিক সময়ের বোনোবোর মতো আকারের ছিল। অধ্যাপক বোহমে বলেন, ‘আমরা ডানুভিয়াস যেভাবে তার পরিবেশে চলেছিল তা পুনর্গঠন করতে সক্ষম হয়েছি। তিনি আরও বলেন, আমরা প্রথমবারের মতো এই নরবানরের একক জীবাশ্ম কঙ্কালের মধ্যে কনুই, কব্জি, নিতম্ব, হাঁটু এবং গোড়ালি সহ বেশ কয়েকটি কার্যকরী গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থল তদন্ত করতে সক্ষম হয়েছি। খুলি থেকে আমরা মুখের বাম অংশ খুঁজে পেয়েছি। আমরা এর দৈর্ঘ্যটি অনুমান করতে পারি - এক মিটার (৩ ফুট ৩ ইঞ্চি) এর থেকে কিছুটা বেশি। মহিলাটির ওজন প্রায় ১৯ কেজি এবং পুরুষটি প্রায় ৩১ কেজি।’
প্রফেসর বোহমে বলেছেন, ‘অঙ্গুলিগ্রন্থি সমৃদ্ধ হেঁটে বেরানো প্রাণী যেমন: শিম্পাঞ্জি, বনোবস এবং গরিলার মতো বর্ধিত হাঁটুর অভাব রয়েছে এবং তাদের বিকাশও কম ঘটেছে।’
দানুভিয়াস আমাদের এমন অবস্থা দেখায় যেখান থেকে বড়ো নরবানর এবং মানুষ পৃথক হয়ে পড়েছিল এবং এই বিবর্তন প্রক্রিয়াটি ঘটেছিল ইউরোপে।
আমাদের অনুসন্ধানগুলি মায়োসিন হোমিনিডস - আফ্রিকান নরবানর এবং মানুষ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানকে ভীষণভাবে বৃদ্ধি করে।
কেন্ট ইউনিভার্সিটির নৃবিজ্ঞানী ট্রেসি কিভেল বলেছেন, ‘এই গবেষণা আমাদের মানব পূর্বপুরুষরা কেন এবং কীভাবে গাছকেন্দ্রিক জীবনযাত্রার উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে পুরোপুরি দুপেয়ে জীবনযাত্রায় স্থিতিশীল অবস্থানে এসেছিলো তার উত্তর পেতে আমাদের আরও কাছাকাছি পৌঁছে দেবে।’
সূত্র: ডেইলি মেইল