বৃহস্পতিবার ● ২৭ আগস্ট ২০১৫
প্রথম পাতা » অলৌকিক নয় লৌকিক » ‘শয়তান তাড়ানোর’ নামে আদিবাসী নারীকে পিটিয়ে হত্যা
‘শয়তান তাড়ানোর’ নামে আদিবাসী নারীকে পিটিয়ে হত্যা
রাজশাহীর তানোর উপজেলার মুন্ডুমালায় সাধুজন মেরি ভিয়ান্নী গির্জায় ‘শয়তান তাড়ানোর’ নামে নির্যাতন চালিয়ে গত ২৫ আগস্ট, ২০১৫ তারিখে মধ্যরাতে এক সাঁওতাল নারীকে হত্যা করা হয়েছে। দৈনিক প্রথম আলো, দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন সহ কয়েকটি পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, ফুলমনি মুরমু (৬০) নামের ওই আদিবাসী মহিলা বেশ কিছুদিন যাবৎ অসুস্থ্য থাকায় ঘটনার দিন সন্ধ্যায় তার দুই মেয়ে আরতি মার্ডি ও শেফালি মার্ডিকে নিয়ে তিনি সাধুজন মেরী ভিয়ান্নী গির্জায় চিকিৎসার জন্য যান। ওই গির্জায় অসুস্থ লোকদের আধ্যাত্মিক উপায়ে সুস্থ্য করা হয় এমন ধারণা ও চর্চা প্রচলিত রয়েছে।
গির্জার ফাদার মাইকেল কুড়াইয়া ফুলমনি মুরমু দেখে বলেন, তার শরীরে অশুভ শক্তি ভর করেছে। অশুভ শক্তি দূর করার জন্য গির্জার শিক্ষিকা বিলাসী সরেনকে নির্দেশ দেন ফাদার। এরপর বিলাসী ঝাড়ফুঁক শুরু করেন। ঝাড়ফুঁকের একপর্যায়ে বিলাসী উপস্থিত সবাইকে বলেন, ফুলমনির শরীরে রাক্ষস ভর করেছে। পরে বিলাসী ও ফাদারের শিষ্য পিয়াস মার্ডি, রতন হাসদা, হিউমাক ববি, ফাল্গুনী মুরমু, বর্ষা মার্ডি ও শম্পা হেমব্রম লাঠি ও গাছের ডাল দিয়ে ফুলমনিকে পেটাতে শুরু করেন। সেই সঙ্গে তারা ফুলমনির গায়ের ওপর ওঠেন ও মাথার চুল ধরে টানাটানি করতে থাকেন। একপর্যায়ে ওই রাতেই ফুলমনির মৃত্যু হয়।
মৃত্যুর ঘটনায় বিলাসী সরেন থানায় বিবৃতি দেন, ফুলমনির শরীরে রাক্ষস ভর করেছিল। শরীর থেকে রাক্ষস বের করার পর তার মৃত্যু হয়েছে। আর ফাদার উল্লেখ করেন, তাদের গির্জায় অসুস্থ লোকদের শুধু ঝাড়ফুঁক দেওয়া হয়, আর কোনো কিছু করা হয় না।
কসমিক কালচার থেকে এই ঘটনাটির বিশ্লেষনে আমরা দেখতে পাই, পূর্বে আদিবাসীদের কোন নির্দিষ্ট ধর্ম ছিল না, বরং তারা নানারকম আদিবাসী প্রথাকেই ধর্ম হিসেবে তাদের মধ্যে লালন করত। ধীরে ধীরে খ্রীষ্টান মিশনারিদের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রলোভনে বা স্বেচ্ছায় তারা ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রীষ্টান ধর্ম গ্রহণ করে। কিন্তু তাদের চিরায়ত বিভিন্ন লোকজ প্রথা পুরোপুরি বিলীন হয়ে যায়নি। ফলে অসুস্থ্যতা দূর করতে আধুনিক চিকিৎসার পরিবর্তে ঝাড়ফুঁক এখনো তাদের সমাজে বিদ্যমান, পাশাপাশি কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনোভাব আমাদের সমাজে সবসময়েই গভীরভাবে প্রোথিত হওয়ায় এই জাতীয় ঘটনা অহরহ ঘটেই চলেছে। কিন্তু বিপত্তি এখানেই শেষ নয়, কোন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত ধর্মগুরু যখন স্বপ্রণোদিত হয়ে শুধুমাত্র বুজরুকি পুজি করে এমন পৈশাচিক কান্ডের অবতারণা করেন তখন তা গোটা সমাজের জন্য একটি নেতিবাচক দৃষ্টান্ত জন্ম দেয়। কারণ এখনো এদেশের সাধারণ মানুষেরা ধর্মীয় গুরুদের ধারণা বা বিশ্বাসকেই গুরুত্ব দিয়ে জীবনাচারণের সাথে সম্পৃক্ত করে রাখে। শয়তান নামক একটি কাল্পনিক চরিত্র প্রায় সব ধর্মেই রয়েছে, ফলে খুব সহজেই ধর্মগুরুরা এই কাল্পনিক চরিত্রের সাথে ধর্মের একটি যোগসূত্র স্থাপন করেন। এমনিতেই নানারকম গোড়ামি আর কুসংস্কার আচ্ছন্ন সমাজে এই ঘটনা সেই বিশ্বাসকেই উত্তোরত্তর বৃদ্ধি করবে। ঝাড়ফুঁক নিতান্তই মানুষের একটি অন্ধবিশ্বাস, যা কোনভাবেই অসুস্থ্যতা দূর করতে তো পারেই না উল্টো তা শারীরিক অসুস্থ্যতা আরও বাড়িয়ে তোলে। ধর্মবিশ্বাসের সাথে ঝাড়ফুঁক দিয়ে রোগ নিরাময়ের কোন যোগসূত্র তো নেই, বরং এটি মানুষকে ধোকা দেয়ার একটি ছলচাতুরি মাত্র। সমাজের প্রতিটি সচেতন মানুষকে তাই এই ধরনের ভন্ডামি ও বুজরুকির আশ্রয় নেয়া ভন্ড ধর্মগুরুদের সনাক্ত করে সাধারণ মানুষের ভুল ভাঙ্গানো একান্ত প্রয়োজন।
সম্পাদনা: কসমিক কালচার
তথ্যসূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৭ আগস্ট, ২০১৫
ছবি: প্রতিকী