রবিবার ● ১০ নভেম্বর ২০১৩
প্রথম পাতা » বিজ্ঞান নিবন্ধ: জ্যোতির্বিজ্ঞান » হাজারো ভিনগ্রহের সন্ধান: মহাজাগতিক ঐকতানে মুখরিত নক্ষত্রবীথি
হাজারো ভিনগ্রহের সন্ধান: মহাজাগতিক ঐকতানে মুখরিত নক্ষত্রবীথি
মহাবিশ্বের অসীময়তার কাছে মানুষের মহাকাশ জয়ের আকাঙ্খা সাফল্যের মুখ দেখে ১৯৬১ সালের ১২ এপ্রিল ইউরি গ্যাগারিনের মহাশূন্যে পদচারনার মধ্যে দিয়ে। পরবর্তীতে শুধু মহাশূন্য পদচারণাতে থেমে না থেকে মহাবিশ্বের পরিচিত সীমানার গণ্ডি ছাড়িয়ে দ্বিতীয় পৃথিবীর সন্ধানে শুরু হয় নানা অভিযান । ভয়েজার, পাইওনিয়ার, কেপলারের মতো মহাকাশযান ভিনগ্রহের খোঁজে সৌরজগতের সীমানা ছাড়িয়ে পাড়ি জমিয়েছে অনন্ত নক্ষত্রবীথিতে। ১৯৯২ সালে গবেষকরা পৃথিবী থেকে ১০০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত একটি ঘূর্ণায়মান নিউট্রন তারা বা পালসার কে প্রদক্ষিণরত দুইটি গ্রহের অস্তিত্ব সনাক্ত করেন। তবে ১৯৯৫ সাল নাগাদ প্রথমবারের মতো আমাদের সূর্য সদৃশ সাধারণ একটি নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণরত ভিন গ্রহের অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। পরবর্তী সময়ে এই জাতীয় গ্রহদের অধিকাংশকেই নাসা’র কেপলার স্পেস টেলিস্কোপের সাহায্যে আবিস্কার করা সম্ভব হয়েছে। সৌরজগতের বাইরে ভিন্ন নক্ষত্রের গ্রহগুলো এক্সোপ্লানেট হিসেবে পরিচিত।
পৃথিবীর বাইরে অন্য নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণরত প্রথম গ্রহটি আবিস্কারের মাত্র দুই দশকের মধ্যেই জ্যোতির্বিদরা এক হাজারতম গ্রহ আবিস্কারের মাইলফলক স্থাপন করেছেন। চলতি বছরের ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা ১০১০ টি বহিঃর্নক্ষত্রের গ্রহ ক্যাটালগভুক্ত করতে পেরেছেন। এক্সোপ্লানেট খুঁজে বেরানো অন্যতম প্রতিষ্ঠান অ্যারেসিবো প্লানেটরি হ্যাবিটাবিলিটি ল্যাবরেটরিতে অবস্থিত পুয়ের্টোরিকো বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাবেল মেন্ডেজ টোরেস বলেন, “অন্য নক্ষত্র পরিবারের মাঝে এমন হাজারো পৃথিবীকে খুঁজে পাওয়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে একটি বিরাট সাফল্য। বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের কাজের ফলেই এই কঠিন মাইলফলক অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। তা সত্ত্বেও অনেকে মনে করেন আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে কোটি কোটি নক্ষত্রের মাঝে দুই দশকে মাত্র ১০০০ টি এক্সোপ্লানেটের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া নগন্য সংখ্যক। আমাদের পরবর্তী লক্ষ্য হবে নতুন নতুন গ্রহ আবিস্করের সাথে সাথে এদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আরও সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করা। ”
গত বছর প্রকাশিত একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে প্রতিটি নক্ষত্রের গড়ে ১.৬টি গ্রহ রয়েছে, এর অর্থ দাড়ায় আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতেই ১৬০০ কোটি গ্রহ রয়েছে। এদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব মাতৃ নক্ষত্র রয়েছে। তবে এর বাইরেও সীমাহীন গ্রহের অস্তিত্ব রয়েছে যারা কোন নক্ষত্রের আওতাধীন নয়। এক্সোপ্লানেট-আবিস্কারের পাঁচটি প্রধান ডাটাবেজ হচ্ছে: দি এক্সট্রাসোলার প্লানেটস্ এনসাইক্লোপিডিয়া (৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ১০৩৮ টি গ্রহ আবিস্কার ক্যাটালগভুক্ত করা হয়), দ্য হ্যাবিটাবিলিটি ল্যাবরেটরি পরিচালিত দি এক্সোপ্লানেটস্ ক্যাটালগ (২৫ অক্টোবর পর্যন্ত ১০২৮ টি গ্রহ আবিস্কার ক্যাটালগভুক্ত করা হয়), দ্য নাসা এক্সোপ্লানেট আর্কাইভ (২৫ অক্টোবর পর্যন্ত ৯৩১ টি গ্রহ আবিস্কার ক্যাটালগভুক্ত করা হয়), দি এক্সোপ্লানেট অরবিট ডাটাবেজ (২৫ অক্টোবর পর্যন্ত ৭৫৫ টি গ্রহ আবিস্কার ক্যাটালগভুক্ত করা হয়), দি ওপেন এক্সোপ্লানেট ক্যাটালগ (৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ৯৭৩ টি গ্রহ আবিস্কার ক্যাটালগভুক্ত করা হয়)। এক্সোপ্লানেটের সনাক্ত ও নিশ্চিতকরণে অনিশ্চয়তার কারণে ডাটাবেজগুলোতে উল্লেখিত সংখ্যার ভিন্নতা রয়েছে। মাত্র দুই দশকে নিশ্চিত হওয়া এক্সোপ্লানেট বা ভিনগ্রহদের সংখ্যার এর নাটকীয় উত্থান নিকট ভবিষ্যতে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের তাদের প্রযুক্তিকে আরও শান দেয়ার এবং সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষনের সুযোগ করে দেবে।
সম্প্রতি পৃথিবী থেকে প্রায় ৪০০ আলোকবর্ষ দূরে বক (সিগন্যাস) নক্ষত্রমণ্ডলীতে কেপলার-৭৮বি নামের একটি এক্সোপ্লানেট আবিস্কৃত হয়েছে। পাথুরে পৃষ্ঠ আর লৌহ কেন্দ্র বিশিষ্ট এই গ্রহটি পৃথিবীর চেয়ে প্রায় ১.২ গুণ বেশি ব্যাস সম্পন্ন এবং ১.৭ গুণ বেশি ভর সম্পন্ন। তবে গ্রহটি তার মাতৃ নক্ষত্রকে অত্যন্ত কাছ দিয়ে প্রদক্ষিণ করছে। পৃথিবীর হিসেবে মাত্র ৮.৫ ঘন্টায় এর বছর সম্পন্ন হয়, যার কারণে এর পৃষ্ঠদেশের তাপমাত্রা পৃথিবীর চেয়ে ২০০০ ডিগ্রী বেশি। বিজ্ঞানীরা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন কেপলার-৭৮বি’র পৃষ্ঠভাগ গলিত ও অত্যন্ত উত্তপ্ত হওয়ায় জীবনধারণের আপাত কোন সম্ভাবনা সেখানে নেই। তবে গঠনের দিক দিয়ে পৃথিবীর সঙ্গে এর গুরুত্বপূর্ণ সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে পৃথিবী সদৃশ আরও গ্রহ সম্পর্কে জানার ক্ষেত্রে এই আবিস্কারকে বিজ্ঞানীরা গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল হিসেবে বিবেচনা করছেন। এ পর্যন্ত আবিস্কৃত হাজারো এক্সোপ্লানেটের কোনটিতে জীবন ধারণের উপযুক্ত পরিবেশ বা জীবনের স্পন্দন রয়েছে কিনা তা বিস্তারিত পরীক্ষা-পর্যবেক্ষণ নির্ভর ও সময়সাপেক্ষ।
কল্পবিজ্ঞানে মহাবিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা মহাজাগতিক কলোনী বা সভ্যতার চিত্র আমাদের কাছে পরিচিতি হলেও বাস্তবে ভিনগ্রহীয় কোন সভ্যতার সন্ধান মেলেনি এখনো। কিন্তু বিজ্ঞানীরা নাছোড়বান্দা! জীবন মানেই যে আমাদের পরিচিত জীবজগতের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে এমন নয়, পৃথিবীর বাইরে মহাজাগতিক পরিবেশে প্রাণের সংগা ভিন্নতর হলেও হতে পারে। জ্যোতির্বিদ ফ্রাঙ্ক ড্রেকই সর্বপ্রথম ১৯৬০ সালে সার্চ ফর এক্সট্রা-টেরিস্টরিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা SETI প্রকল্প শুরু করেন, যা প্রজেক্ট ওজমা নামে পরিচিত। পৃথিবীতে প্রাণ উদ্ভবের পেছনে সম্ভাব্য কারণ হিসেবে উল্কাপাত বা ধূমকেতুর সংশ্লিষ্টতা বিজ্ঞানীরা জোর দিয়েই স্বীকার করেছেন। তাই অসীম এই মহাবিশ্বের অন্য কোন না কোন প্রান্তে প্রাণের উদ্ভব ঘটা সম্ভব কিংবা প্রাণের বিকাশের অনুকূল পরিবেশ রয়েছে এমন ধারণা বিজ্ঞানীরা কখনোই উড়িয়ে দেননি। মানুষের বাসযোগ্য ভিনগ্রহ বা ভিনগ্রহে প্রাণের অস্তিত্বের সন্ধান আদৌ মিলবে কিনা সে বিষয়ে বিতর্কের অবসান না হলেও এই অনুসন্ধান নিঃসন্দেহে মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্য এবং প্রাণের বিকাশের অমিমাংসীত বিভিন্ন সমাধানের পথ খুলে দেবে।
সম্পাদনা: যোয়েল কর্মকার
সূত্র: নাসা
১ নভেম্বর, ২০১৩