শনিবার ● ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১১
প্রথম পাতা » বিজ্ঞান নিবন্ধ: জ্যোতির্বিজ্ঞান » সময় ভ্রমন - আতাউর রহমান সুরুজ
সময় ভ্রমন - আতাউর রহমান সুরুজ
ভবিষ্যত নির্ধারণ
সময় ভ্রমনের মাধ্যমে ভবিষ্যত কিংবা অতীতে চলে যাওয়া সব সময়েই বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী লেখকদের আগ্রহ যুগিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এটি অসম্ভব বলে মনে করেন অনেকেই এবং তাদের বিতর্ক ছিল ‘গ্রান্ডফাদার প্যারাডক্স’ নিয়ে। এই বিতর্কে ব্যাখ্যা করা হয়, আপনি যদি অতীতে গিয়ে আপনার নানা-নানীর মিলন বাধাগ্রস্থ করেন, তবে আপনার মা কিভাবে জন্ম নেবেন? তাহলে তো আপনিও জন্ম নেবেন না, .. .. এই জাতীয় চিন্তাভাবনা। আর এই বিতর্ক থেকেই কিছুদিন আগ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতেন সময় ভ্রমন কেবল কল্পবিজ্ঞানেই সম্ভব। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে কোয়ান্টাম তত্ত্বেও কিছু রূপায়নের ফলে আজ মনে হচ্ছে সময় ভ্রমন সম্ভব, অন্ততঃ তাত্ত্বিকভাবে।
মহাকর্ষ এবং কৃষ্ণগহ্বর
আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা সূত্র মহাবিশ্ব ও সময়কে একটি চতুর্মাত্রিক ধারণায় নিয়ে এসেছে। যাকে তিনি মহাকাশ সময় বলে অভিহিত করেছেন। আমরা মহাকাশের সামনে, পেছনে, পাশে গমন করতে পারলে সময়ের ক্ষেত্রে কেন এমনটি সম্ভব নয়? যেহেতু চতুর্মাত্রিক জগত কল্পনা করা কঠিন, তাই পদার্থবিজ্ঞানীরা উদাহরনস্বরূপ মহাকাশসময়কে একটি সমানভাবে বিছানো রবারের শীট হিসাবে কল্পনা করেছেন। যদি এর আশেপাশে কোন বড় ভর বিশিষ্ট বস্তু না থাকে তবে এর উপরে রাখা যে কোন বস্তু সরলরেখায় এর চারপাশে ঘুরবে। কিন্তু একটি বড় ভর বিশিষ্ট বস্তু, যেমন সূর্য, এই শীটে ডুব দেয় কারণ, প্রকৃতপক্ষে ইহা মহাকাশ সময়কে বিকৃত করে। এখন অন্যান্য কম ভর বিশিষ্ট বস্তু, যেমন আমাদের পৃথিবী যা মহাকাশ সময়ে ঘুরছে, সেটি সূর্যের পিছন পিছন ডুব দেয়। মনে হয় এটি বড় ভরের বস্তুর প্রতি আকর্ষিত। মহাকাশ সময়ের এই বিকৃত করার প্রভাব মহাকর্ষ শক্তিতে জাগিয়ে তোলে। বিশ্ব-ব্রহ্মান্ড অনেক ভারী বস্তুতে পরিপূর্ণ যা মহাকার্ষিক প্রভাবের জানান দিচ্ছে। এর ফলাফল হিসাবে এটাই সুস্পষ্ট হয় যে সর্বত্র মহাকাশ সমান সমতল নয় বরং বক্রতল। আলো সহ সবকিছুকে মহাকাশ সময়ের এই বক্রপথ অনুসরণ করতে হয়। আমরা জানি আইনস্টাইন এ ব্যাপারে নির্ভূল ছিলেন কারণ মহাকাশবিজ্ঞানীরা আনেক সময় দূরের নক্ষত্র দেখতে পায় যা নিকটতম বস্তুর (যেমন: সূর্য) আড়ালে থাকার কথা। সরাসরি না গিয়ে এবং বাঁধা পেয়ে এসব নক্ষত্রের আলো বাঁধাপ্রদত্ত বস্তু থেকে মোড় ঘুরিয়ে নেয়। যখন একটি নক্ষত্রের আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে যায় তখন এটি এর নিজের মহাকর্ষ শক্তির কারণে এমনভাবে গুটিয়ে যায় যে এর সকল পদার্থ এর মূল আকৃতির ভগ্নাংশ হয়ে হয়ে ঘনবস্তুর মত কেন্দ্রীভূত হয়। যা কৃষ্ণগহ্বর হিসাবে পরিচিত। কৃষ্ণগহ্বরে মহাকর্ষ শক্তি এতো বেশি যে কোন বস্তু একে এড়াতে পারে না, এমনকি আলোও। আমরা তাদের দেখতে না পেলেও আমাদের কাছে এদের অস্তিত্বের প্রমান রয়েছে। আমরা নক্ষত্রদের এমনভাবে ঘুরতে দেখি যা থেকে মনে হয় কোন অদৃশ্য বিশাল ভরের বস্তু এদের আকর্ষণ করছে। মহাকাশ সময়ের ক্ষেত্রে কৃষ্ণগহ্বরের কি প্রভাব রয়েছে? আপেক্ষিকতাবাদ থেকে মনে করা হয় কৃষ্ণগহ্বরের কেন্দ্র ঘন, ধারণা করা হয় সেখানে পদার্থবিজ্ঞানের কোন সূত্র কাজ করবে না। সময়, স্থান, শক্তি এবং পদার্থের কোন আলাদা পরিচয় থাকবে না। আইনস্টাইনের সূত্র দেখায় যে, এই এককতা মহাকাশ সময়ের রাবার শীটে শুধু ডুবই দেবে না বরং এটি ঠিক ভিতর দিয়ে একটি টানেল তৈরি করবে এবং মুহুর্তের মধ্যে অন্য প্রান্তে পৌঁছে যাবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কোথায় সেই অন্য প্রান্ত। এটা হতে পারে মহাকাশ সময়ের অতীত বা ভবিষ্যত সময়ের যেকোন সময় অথবা অন্য কোন মহাবিশ্ব।
ক্ষুদ্র সময় সুড়ঙ্গ
আইনস্টাইনের সূত্র বর্ণনা করে একটি মহাকাশ সময়ের যা রবার শীটের মত সমতল। তার আপেক্ষিকতার সূত্র পদার্থবিদ্যার সেই সকল ক্ষেত্রেই কাজ করে যা শুধুমাত্র উচ্চমাত্রায় ঘটে থাকে। কিন্তু এটা কৃষ্ণগহ্বরের কেন্দ্রে কি ঘটছে অথবা মহাবিশ্বের জন্মলগ্নের বিগ ব্যাং সময়ে কি ঘটেছিল যখন মহাকাশ সময়ও ছিল ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সে সম্বন্ধে কোন ধারণা দেয় না। এটি আমাদেরকে কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার জগতে ফিরিয়ে নেয়। আপনি যদি মহাকাশ সময়ের দিকে একটি শক্তিশালী আঁতশ কাঁচ দিয়ে তাকান যা কোয়ান্টাম স্কেলের নিচ পর্যন্ত পৌঁছায়, তবে আপনি সমতল এবং সমানভাবে আইনস্টাইনের মহাকাশ সময়র শীট দেখতে পাবেন না। রবারের বল যেমন দূর থেকে মসৃণ মনে হলেও কাছে থেকে অমসৃণ অনেকটা সেরকম। মহাকাশ সময়ের এই লেখ থেকে ধারণা করা যায় কোন ক্ষুদ্র সময় সুড়ঙ্গ খুলেও যেতে পারে, যা নিয়ে যেতে পারে বর্তমান সময় থেকে অন্য কোন সময়ে কিংবা অন্য কোন মহাবিশ্বে।
অনেক বিশ্ব, অনেক ভবিষ্যত
এখন আমরা ফিরে আসি সেই প্রশ্নে যা নিউটনের সময় থেকে চিন্তাবিদদের ধাঁধায় ফেলেছে। ভবিষ্যত কি পূর্বেই নির্ধারণ করা যাবে? আর ভবিষ্যত কি অসীম সংখ্যার? কোয়ান্টাম জগতের ধারণায় শুধু ভবিষ্যতই নয় মহাবিশ্বও অনির্দিষ্ট সংখ্যার হতে পারে। ফোটন এবং ইলেকট্রন কখনো তরঙ্গের মত, কখনো কণার মত আচরণ করে, কিন্তু একই সময়ে দুই অবস্থায় আচরণ করে না। কোয়ান্টাম পর্যায়েই শুধুমাত্র এই ঘটনা ঘটে থাকে যা এক মহাবিশ্বের সাথে অপর মহাবিশ্বের তরঙ্গের সংঘর্ষ সময়ে ঘটে। সমান্তরাল মহাবিশ্বের ধারণা ‘গ্রান্ডফাদার প্যারাডক্স’ সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান দেয় যা সময় ভ্রমনকারীদের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করত। যদি আমরা অতীতে ফিরে যাই এবং ইতিহাস বদলে দেই তবে আমরা আমাদের একটি সমান্তরাল বিশ্বের দিকে ধাবিত হব, কিন্তু তা আমাদের বর্তমান অবস্থার উপর কোন প্রভাব বিস্তার করবে না। ভবিষ্যতের বিজ্ঞানীরা হয়তোবা কোয়ান্টাম প্রস্তাবের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা ভবিষ্যত প্রযুক্তির নবরূপ নিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছতে চেষ্টা করবে। এ ধরনের আবেদন কোয়ান্টাম টেরিপোর্টেশনকে অন্তর্ভূক্ত করবে যা দ্বারা একটি কোয়ান্টাম কণিকা মহাবিশ্বের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রানে- পাঠানো সম্ভব হবে এবং কোয়ান্টাম গণনা,যা এই প্রক্রিয়াকে কাজে লাগিয়ে নিমিষে করা সম্ভব হবে কিন্তু সাধারণ গণনাযন্ত্রে গণনা করতে লেগে যাবে বহু বছর। যদিও আমরা জানি কিভাবে সঠিকভাবে সময় পরিমাপ করতে হয়, তারপরেও হয়তো এই প্রশ্নের নিকটবর্তী সন্তোষজনক উত্তর পাওয়া সম্ভব হবে - সময় কি?
লেখক: বিজ্ঞান কর্মী, কসমিক কালচার।
উৎস: অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার লেকচারার নেইল জনসন’র লেখা অবলম্বনে।