বৃহস্পতিবার ● ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৩
প্রথম পাতা » বিজ্ঞান নিবন্ধ: জ্যোতির্বিজ্ঞান » মঙ্গলের হাতছানি: বসতি গড়ার অপেক্ষায় ২০২৩ - যোয়েল কর্মকার
মঙ্গলের হাতছানি: বসতি গড়ার অপেক্ষায় ২০২৩ - যোয়েল কর্মকার
রাতের আকাশে মিটিমিটি জ্বলতে থাকা দূর নক্ষত্র বা হঠাৎ ছুটে চলা উল্কা’র আবেশ মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলে প্রহেলিকাময় এক জগতে, যা মহাবিশ্বের অনন্ত সীমানায় কোন কল্পলোকে নিয়ে যায় আমাদের। অনন্ত মহাবিশ্ব জয়ের নেশায় এমনি করেই কল্পলোক থেকে বাস্তবে ৫২ বছর আগে ইউরি গ্যাগারিন পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষনের প্রভাব কাটিয়ে অদম্য সাহসিকতায় পাড়ি জমিয়েছিলেন মহাকাশে। সূচিত হয়েছিল মানবেতিহাসের এক অনন্য ধারা। যার ধারাবাহিকতায় নীল আর্মস্ট্রং, ভ্যালেন্তিনা তেরেসকোভা সহ বহু নভোচরী অবিস্মরনীয় সব অভিযান পরিচালনা করেছেন। সর্বশেষ মঙ্গল অভিযাত্রায় শামিল হয়েছে মার্স-ওয়ান মিশন। মহাকাশে উপনিবেশ স্থাপনের ধারণাকে বাস্তবে রূপ দিতে গত বছর মঙ্গলে বসতি গড়ার ঘোষণা দিয়ে আলোচনায় আসে নেদারল্যান্ডভিত্তিক বেসরকারি মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান মার্স ওয়ান। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ২০২৩ সালে মঙ্গলে প্রথম মানব বসতি স্থাপনের কাজ শুরু হবে।
পৃথিবীর অর্ধেক ব্যাসার্ধ্যের এবং এক দশমাংশ ভরের এই লাল প্রতিবেশী গ্রহকে ঘিরে বিজ্ঞানীদের কৌতুহল বেশ পুরোনো। কারণ সৌরজগতের মধ্যে পৃথিবীর বাইরে প্রাণের বিকাশ মঙ্গলেই ঘটেছিল এমন ধারণা ও প্রমান বিজ্ঞানীদের আরও ঔৎসুক করে তুলেছিল। মার্কিন মহাকাশ গবেষনা সংস্থা নাসা’র মেরিনার-৪ মহাকাশযান ১৯৬৪ সালে প্রথমবারের মত মঙ্গলে ফ্লাই-বাই করতে সমর্থ হয়। এরপর ১৯৭১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের মার্স প্রোব প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে মার্স-২ এবং মার্স-৩ প্রথমবারের মঙ্গলের পৃষ্ঠে অবতরণ করে। পরবর্তীতে কয়েকটি দেশের মহাকাশ গবেষণার অংশ হিসেবে মঙ্গলে বেশ কতগুলো সফল অভিযান পরিচালনা করা হয়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে: নাসা’র স্মরনীয় ভাইকিং প্রোগ্রামের আওতায় ১৯৭৬ সালে ভাইকিং-১ এবং ভাইকিং-২ মঙ্গলের ভূমিতে অবতরণ করে। ভাইকিং এর সাথে থাকা ল্যান্ডারের মাধ্যমে প্রথম মঙ্গলের রঙিন ছবি রিলে করে পৃথিবীতে পাঠানো হয়। এই অভিযানের ঠিক পরেই আবার সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৮৮ মঙ্গল পর্যবেক্ষণের জন্য ফোবোস ১ এবং ফোবোস ২ মহাকাশযান প্রেরণ করে। এরপরে আবার নাসা ১৯৯২ সালে মার্স অবজারভার অর্বিটার, ১৯৯৬ সালে মঙ্গলের মানচিত্রায়নের জন্য মার্স গ্লোবাল সার্ভেয়ার এবং মার্স পাথফাইন্ডার প্রেরণ করে। পাথফাইন্ডারের সোজার্নার নামক একটি রোবোটিক যান ছিল, যা মঙ্গলের প্রচুর ছবি তুলতে সক্ষম হয়। এই সফলতার পরে নাসা ২০০১ সালে মার্স অডিসি অর্বিটার উৎক্ষেপণ করে। ২০০৩ সালে ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি মার্স এক্সপ্রেস অরবিটার এবং বিগ্ল ২ নামক ল্যান্ডার সমতে মার্স এক্সপ্রেস ক্র্যাফ্ট উৎক্ষেপণ করে। একই বছরে নাসা স্পিরিট ও অপরচুনিটি নামের দুটি যমজ রোভার মঙ্গলে পাঠায়। ২০০৫ সালে নাসা পুনরায় মার্স রিকনিসন্স অর্বিটার নামক একটি সন্ধানী যান উৎক্ষেপণ করে। এরপরে ২০০৭ সালে আবার নাসা ফিনিক্স মার্স ল্যান্ডার প্রেরণ করে। মঙ্গলের আবহাওয়া ও পৃষ্ঠের গঠন পরীক্ষা, জলের সন্ধান এবং সর্বোপরি প্রাণের সন্ধান করা ছিল এইসব অভিযানের মূল লক্ষ্য।
মঙ্গলে জীবনের খোঁজে অনুসন্ধান চালিয়ে বাসযোগ্য কোন পরিবেশের সম্ভবনা মেলেনি। গ্রহটি জীবনধারণের জন্য মোটেও অনুকূল নয়। মঙ্গলে নেই কোন চৌকম্বীয় ক্ষেত্র, শুধুমাত্র যৎসামান্য যে বায়ুমণ্ডল রয়েছে সেখানে প্রাণের অস্তিত্ব থাকা কোনভাবেই সম্ভব নয়। এছাড়া মঙ্গলের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি পৃথিবীর সাপেক্ষে প্রায় দশ ভাগের এক ভাগ মাত্র। এসব সত্ত্বেও মার্স ওয়ান মিশন প্রগলভতা নিয়েই মঙ্গলে বসতি স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জন এফ, কেনেডি হাস্টনের রাইস বিশ্ববিদ্যালয়ে তার স্মরণীয় বক্তৃতায় বলেছিলেন, “চাঁদে যাওয়াটা সহজ একারণে নয় বরং এটি কঠিন বলেই আমরা চাঁদে যাওয়া বেছে নিয়েছি।” মার্স-ওয়ান কর্তৃপক্ষ সেই একই ধারণা পোষন করে মঙ্গলে বসতি গড়ার পরিকলল্পনা করেছেন। তাদের মতে মঙ্গলে মানববসতি গড়ে তোলা মানবজাতির জন্য পরবর্তী বৃহৎ পদক্ষেপ। মহাবিশ্বে মানুষের দীর্ঘযাত্রার ক্ষেত্রে মঙ্গল হবে প্রথম পা ফেলার জায়গা।
অবিশ্বাস্য প্রচেষ্টার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে তারা ২২ এপ্রিল, ২০১৩ তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে মঙ্গলে বাস করতে আগ্রহী ১৮ বছরের উর্ধ্বে মানসিক ও শারীরিকভাবে সুস্থ পৃথিবীবাসীদের কাছে উন্মুক্তভাবে আবেদন আহ্বানের মাত্র চার মাসের মধ্যেই লক্ষাধিক আবেদনপত্র জমা পড়ে। পরিকল্পনা অনুযায়ী আবেদনকারীদের মধ্যে থেকে মাত্র ৪০ জনকে বেছে নেয়া হবে মঙ্গলবাসের জন্য। তবে এদের মধ্যে থেকে কে হবেন প্রথম মঙ্গলমানব তা ভোটের মাধ্যমে চূড়ান্ত করা হবে। ২০১৫ সালে নির্বাচিতদের নিয়ে পূর্ণমাত্রার প্রশিক্ষণ শুরু হবে, যা ২০২২ সালে উড্ডয়নের পূর্ব পর্যন্ত অব্যহত থাকবে। ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে পরীক্ষামূলকভাবে একটি মিশন পরিচালনা করা হবে, যা মানুষ পাঠানোর আগে প্রযুক্তিগত কিছু ধারণা পরীক্ষা করে দেখবে। ২০১৮ সালে রোভার ও যোগাযোগ স্যাটেলাইট পাঠানো হবে। মঙ্গলে অবতরণ স্থল নির্ধারণের পর রোভারটি কার্গো মিশনের জন্য জায়গা প্রস্তুত করবে, একইসাথে সোলার প্যানেল বসানোর জন্যও জায়গা তৈরি করবে। ছয়টি কার্গো মিশন পরিচালিত হবে ২০২০ সালে, যেখানে ২টি বসবাসের ইউনিট, ২টি লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম এবং ২টি সাপ্লাই ইউনিট থাকবে। ২০২১ সালে কার্গো ৬টি স্থাপন করা হবে। এরপর ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথম নভোচারী প্রেরণ করা হবে। ২১০ দিনের যাত্রা শেষে তারা ২০২৩ সালে মঙ্গলে অবতরণ করবে। এই যাত্রায় চারজন করে নভোচারী পাঠানো হবে। কারণ চারজনের একটি দল সবচেয়ে নিখুঁতভাবে টিকে থাকার সংগ্রাম করতে পারবে। পরবর্তীতে ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে দ্বিতীয়বারের মতো মানুষ পাঠানো হবে। এক্ষেত্রে তারা ২৪০ দিন যাত্রা করে ২০২৫ সালের জুলাই মাসে মঙ্গলে পৌঁছবে। এরপর থেকে প্রতি দুই বছর অন্তর নতুন অভিযাত্রীদের নিয়ে যাওয়া হবে মঙ্গলে। তারাই প্রযু্ক্তি সহায়তা নিয়ে মঙ্গল গ্রহে বাসযোগ্য পরিবেশ তৈরির জন্য চেষ্টা করবে। এভাবেই মঙ্গলে গড়ে তোলা হবে স্থায়ী মানব বসতি। যদিও সেখানে থাকবে না চিরচেনা পৃথিবীর আকুলতা।
মানুষের মহাকাশ অভিযাত্রার প্রতি পদে পদে রয়েছে বিপদ। আর মঙ্গল গ্রহের পরিবেশ এতোটাই বিপদসঙ্কুল যে সাধারণ একটি ভুল বিরাট বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত। প্রতিকূল পরিবেশে প্রতিটি সরঞ্জামাদিকেও নির্ভূলভাবে কাজ করতে হবে। মার্স ওয়ানের ঘোষণা অনুযায়ী পৃথিবীকে বিদায় জানিয়ে পাড়ি জমাতে হবে পাথুরে লাল গ্রহ মঙ্গলে। এই যাত্রা হবে একমুখী অর্থাৎ আর কোনোদিনই পৃথিবীতে ফেরা হবে না। তবুও মঙ্গল গ্রহে স্থায়ী বসবাসের জন্য মার্স ওয়ানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে জমা পড়ে লক্ষাধিক আবেদনপত্র। পৃথিবীতে আর ফেরা হবে না জেনেও এই অগ্যস্ত যাত্রার জন্য আবেদন করেছেন ১৮ জন বাংলাদেশী নাগরিক (মার্স-ওয়ান ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে), যাদের মধ্যে রয়েছেন এক দম্পতিও।
মঙ্গলযাত্রায় বাংলাদেশী আবেদনকারীরা হলেন: সাদমান (১৯), মাহমুদ-আল-নূর নির্ঝর (২৩), এহশাম (২৪), সাইপ্রাস প্রবাসী এনায়েত হোসেন (২৫), সালমা মেহের ঐশী (২৭), ইয়ামিন মাহমুদ দীপু (২৭), আবুধাবি প্রবাসী রাজিব (২৮), লাবণ্যা (২৯), মেহেদী মিজান (৩০), মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম রনি (৩১), কানাডা প্রবাসী শরীফ (৩২), হাবিব দুলাল (৩৫), মোঃ জাকারিয়া হাবিব (৩৫), মোহাম্মদ (৩৫), উত্তম বড়ুয়া (৪০), মোহাম্মদ রাশেদুন নবী হারুন (৪৭) এবং অস্ট্রেলিয়ার বসবাসরত এনামুল হক (৩১) ও তার স্ত্রী শারমিন জাহান (২৫)।
প্রথম রাউন্ডের আবেদন গ্রহণের সময় ৩১ আগস্ট, ২০১৩ তারিখ শেষ হয়ে গেছে। তবে এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া এবং নিয়মিতভাবেই আবেদন আহ্বান করা হবে। http://www.mars-one.com ওয়েবসাইটের মাধ্যমে আগ্রহী যে কেউ নামমাত্র ফি ও প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদান করে রেজিষ্ট্রেশন করতে পারবেন।
মঙ্গলে অভিযানে অংশ নেয়া মহাকাশযানগুলোর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই কৌশলগত সমস্যার কারণে ব্যর্থ মিশনে পরিণত হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ইউরোপ, জাপানের মতো উন্নত দেশগুলোর এই ব্যর্থতার সামনে অনেকটাই অপরিচিত মার্স-ওয়ান প্রতিষ্ঠানটির মঙ্গল অভিযানের ঘোষণার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে শুরু থেকেই সংশয় সৃষ্টি হয়েছিল। যেখানে মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা এবং ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি আগামী ২০৩০ থেকে ২০৩৫ সালে মঙ্গলে পৌঁছানোর চেষ্টা চালাচ্ছে সেখানে এই প্রকল্পটি হয় ইতিহাসের একটি বড় ধোঁকাবাজি, নয়তো মহাকাশ ভ্রমণের সীমাকে চ্যালেঞ্জ করার এক সাহসী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হবে। কিন্তু ইতিহাস আমাদের শেখায় প্রতিকূলতাকে কাটিয়ে সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে উন্নততর প্রযুক্তি আবিস্কার ও দুঃসাহসিক সব অভিযান পরিচালনার। এ যেন আত্ম-ধ্বংসের কুজ্ঝটিকায় ঘেরা পৃথিবী পেরিয়ে শান্তির আবাসের খোঁজে এক অদম্য দুঃসাহসিক অভিযান। বাংলাদেশী নাগরিক মোহাম্মদ রাশেদুন নবী হারুন এর প্রোফাইল ভিডিওতে ফুঁটে উঠেছে তেমনি আকুতি। দেশ জুড়ে গন্ডগোল, হানাহানি আর অস্থিরতা থেকে দূরে গিয়ে পৃথিবীর বাইরে অন্য কোথাও শান্তির আবাস গড়ে তোলার জন্য এই অন্তিম যাত্রায় তিনিও শামিল হতে চান। প্রিয় পৃথিবীতে আর কখনোই ফেরা হবে না জেনেও আগামী প্রজন্মের জন্য জ্ঞানচর্চার পবিবেশ ও প্রাযুক্তিক বিকাশের পথকে সুগম করতেই এই ত্যাগের মানসিকতা। মঙ্গলের হাতছানি কি আদৌ সেই সম্ভাবনার পথ করে দেবে? হয়তো মহাকাশই হবে আমাদের পরবর্তী ঠিকানা, আগামীর সীমান্ত।