বুধবার ● ৬ জুন ২০১৮
প্রথম পাতা » বিজ্ঞান নিবন্ধ: প্রকৃতি ও পরিবেশ » সুপারবাগ: চিকিৎসা বিজ্ঞানের আতঙ্ক - রাজীব নন্দী
সুপারবাগ: চিকিৎসা বিজ্ঞানের আতঙ্ক - রাজীব নন্দী
ভাবুন তো, আপনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, নামকরা বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখাচ্ছেন, কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। ডাক্তার ডায়াগনোসিস করে দেখল আপনার সবকিছু ঠিকঠাক, তবুও ওষুধে কোনো কাজ হচ্ছে না। খুবই উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো ব্যাপার, তাই না? এমন ঘটনাই প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে বর্তমান পৃথিবীতে, যা নিয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের ঘুম হারাম। যখন কোনো মাইক্রোঅর্গানিজম (বিশেষত ব্যাকটেরিয়া) অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী হয়ে ওঠে, তখন সেটাকে বলে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্টেন্স। আর যখন কোনো ব্যাকটেরিয়া একাধিক ড্রাগ রেজিস্টেন্স জিন বহন করে তখন তাকে বলা হয় মাল্টিড্রাগ রেজিস্টেন্ট বা সুপার বাগ।
অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্ট ব্যাকটেরিয়া অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে পারে। ব্যাকটেরিয়া প্রতি ২০ মিনিটে বংশ বৃদ্ধি করে দ্বিগুণ হয়। এমনকি ব্যাকটেরিওফাজ ভাইরাসও সুপারবাগ বহন করতে পারে। জেনে অবাক হবেন, প্রতি বছর আমেরিকায় ২ মিলিয়ন লোক এমন ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয়, যা অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্সি দেখায় এবং এর মধ্যে ২৩ হাজার লোক মৃত্যুবরণ করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এখনই সাবধান না হলে ২০৫০ সালের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার কারণে প্রতি বছর এক কোটি লোক মারা যাবে এবং ১০০ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি আর্থিক ক্ষতি হবে।
প্রশ্ন হতে পারে, ব্যাকটেরিয়াও মানুষের মতো এত রূপ বদলায় কেন? প্রত্যেক জীবকেই বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করতে হয়। আমরা যখন ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলার জন্য প্রতিনিয়ত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করতে থাকি তখন ব্যাকটেরিয়াও নিশ্চয়ই বেঁচে থাকার জন্য কোনো উপায় খুঁজতে থাকবে। আসল কথায় আসি। ব্যাকটেরিয়া অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্ট হতে পারে প্রধানত তিনটি কারণে। প্রথমত, ন্যাচারালি রেজিস্টেন্ট হওয়া; দ্বিতীয়ত, মিউটেশনের মাধ্যমে; তৃতীয়ত, অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহারের ফলে। সবরকম অনুজীবই এই রেজিস্টেন্সি দেখাতে পারে। ভাইরাসের ক্ষেত্রে অ্যান্টিভাইরাল রেজিস্টেন্স, ফাঙ্গাসের ক্ষেত্রে অ্যান্টিফাঙ্গাল রেজিস্টেন্স, প্রোটোজোয়ার ক্ষেত্রে অ্যান্টিপ্রোটোজোয়াল রেজিস্টেন্স এবং ব্যাকটেরিয়ার ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্স।
মানুষের প্রতিদিনের খাবার প্লেটে আমিষ যে অংশ দখল করে রাখে, সেখানে নিরাপদ খাবার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ভেটেরিনারিয়ানদের অবদান বর্ণনাতীত। পোলট্রি শিল্পে কিংবা অন্যান্য প্রাণীতে অত্যাধিক অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে তা খাবারের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে মানুষের দেহেই প্রবেশ করে। এখন পোল্ট্রি ফিডেও ফিড কোম্পানিগুলো সচরাচর অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করে থাকে। মানুষ দৃষ্টির অগোচরেই এভাবে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করে থাকে, যার ফলে মানবদেহে ব্যাকটেরিয়া রেজিস্টেন্সি দেখায়। তাই হিউম্যান মেডিসিন ও ভেটেরিনারি মেডিসিনকে এ ক্ষেত্রে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই।
অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্সি রোধে প্রেসক্রিপশন ছাড়া মেডিসিন গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে। প্রেসক্রিপশনের সঙ্গে যে পাঁচটি বিষয় মনে রাখা জরুরি তা হল, রাইট পেশেন্ট, রাইট ড্রাগস, রাইট ডোজ, রাইট রুট ও রাইট টাইম। অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্সি বা সুপারবাগ একটি বৈশ্বিক সমস্যা। তাই কোনো একক দেশ এর সমাধান করতে পারবে না। যত নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থাই থাকুক না কেন, সুপারবাগের এক দেশ থেকে অন্য দেশে প্রবেশ থামানো যাবে না। এর জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, গণমাধ্যম- সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা জরুরি। ইতিহাস বলে, বহু মহামারী রোগ মানুষ জয় করে ফেলেছে। সুপারবাগ বিস্ফোরণের বিরুদ্ধেও মানুষকে জয়ী হতে হবে।
লেখক: রাজীব নন্দী, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
যুগান্তর, সম্পাদকীয় পাতায় ২৭-০৫-২০১৮ তারিখে প্রকাশিত