শুক্রবার ● ১৫ মার্চ ২০১৯
প্রথম পাতা » বিজ্ঞান নিবন্ধ: প্রকৃতি ও পরিবেশ » অ্যান্টিবায়োটিকের অকার্যকরতা হয়ে উঠছে মানবদেহের জন্য হুমকি - তাওছিয়া তাজমিম
অ্যান্টিবায়োটিকের অকার্যকরতা হয়ে উঠছে মানবদেহের জন্য হুমকি - তাওছিয়া তাজমিম
দৈনন্দিন জীবনে আমাদের কাছে ওষুধ হিসেবে অ্যান্টিবায়োটিক বহুল প্রচলিত ও ব্যবহৃত হয়ে উঠেছে। অ্যান্টিবায়োটিক হলো কয়েক ধরণের জৈব-রাসায়নিক ঔষধ যা বিভিন্ন অণুজীবদের বৃদ্ধিরোধ বা অকার্যকর করে দেয়। অ্যান্টিবায়োটিকগুলো অণুজীবের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ভাবে কাজ করে। বিভিন্ন ব্যাক্টেরিয়া ও ছত্রাক অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করে। অ্যান্টিবায়োটিক সাধারণভাবে ব্যাক্টেরিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহার হয়, ভাইরাসের বিরুদ্ধে এগুলো কাজ করে না।
বর্তমানে আমরা জ্বর, কাশি, সর্দি হলেই অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠি। আমরা কখনো ডাক্তারের পরামর্শে আবার কখনোবা নিজেদের বিবেচনায় অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করে থাকি। এছাড়া ফার্মেসীতে হরহামেশাই প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি হয়। দেখা যায় শিশুদের ক্ষেত্রে দ্রুত সুস্থ্যতার আশায় আমরা নিজেরাই ডাক্তারকে অ্যান্টিবায়োটিক প্রেসক্রাইব করতে চাপ দিয়ে থাকি। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে,আমরা ব্যাকটেরিয়া ছাড়াও প্রতিদিন নানা ধরনের ভাইরাস দ্বারাও আক্রান্ত হচ্ছি। ভাইরাসজনিত এসব রোগে অ্যান্টিবায়োটিকের কোনো ভূমিকা নেই।
এবার জেনে নেওয়া যাক অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বিষয়টি। অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতিতে ব্যাকটেরিয়ার বেঁচে থাকার ও বংশবিস্তার করার ক্ষমতা অর্জনই অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স। অ্যান্টিবায়োটিকের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার, নিয়ম না মেনে ব্যবহারের কারণে জীবাণুরা অ্যান্টিবায়োটিক চিনে ফেলে রূপান্তরিত হয়ে পড়ে। ফলে অ্যান্টিবায়োটিক আগের মতো শরীরে ঠিকভাবে কাজ করে না, এতে করে বেড়ে যাচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের ঝুঁকি। পাশাপাশি পরিবেশেও ছড়িয়ে পড়ছে ড্রাগ রেসিস্ট্যান্ট জীবাণু।
কেস স্টাডি
সিজারিয়ান প্রসবের পর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয় রাজধানীর ওয়ারীর বাসিন্দা সৈয়দা মেহজাবিনের (৩৮)। রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ১৭ ডিসেম্বর তার চিকিৎসা শুরু হয়। সেখান থেকে ২৩ ডিসেম্বর তাকে ভর্তি করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ)। সেই থেকে দুই মাস ধরে আইসিইউর ১৭ নম্বর শয্যায় চিকিৎসাধীন তিনি। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা গেছে, একটি মাত্র অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে তার শরীরে, যেটি আবার কিডনির জন্য ক্ষতিকর।
সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার পর যশোর সদর হাসপাতালে ভর্তি হন মাগুরার অমিত কর (২৭)। অবস্থার অবনতি হলে সেখান থেকে স্থানান্তর করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে। গত বছরের নভেম্বরে তাকে ভর্তি করা হয় বিএসএমএমইউর আইসিইউতে। এখন পর্যন্ত আইসিইউতেই চিকিৎসা চলছে তার। সৈয়দা মেহজাবিনের মতো অমিতের শরীরেও মাত্র একটি অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে।
সৈয়দা মেহজাবিন ও অমিত করের প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১৪টি অ্যান্টিবায়োটিকের নামের পাশে ‘আর’ (রেজিস্ট্যান্স) লেখা। শুধু কোলিস্টিন সালফেট নামের অ্যান্টিবায়োটিকের পাশে লেখা ‘এস’ (সেনসিটিভ)। অর্থাৎ তাদের শরীরের ব্যাকটেরিয়া দমন করতে পারবে শুধু কোলিস্টিন সালফেট। তবে চিকিৎসকরা বলছেন, কোলিস্টিন সালফেটের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধ করলেও রোগীর কিডনির জন্য ক্ষতিকর এটি।
বিএসএমএমইউর অ্যানেসথেসিয়া, অ্যানালজেসিয়া অ্যান্ড ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিন বিভাগের কনসালট্যান্ট ডা. এ কে এম হাবিব উল্লাহ এই প্রতিবেদককে জানান, সৈয়দা মেহজাবিন ও অমিত কর অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট হয়েই আইসিইউতে এসেছেন। তাদের শরীরে ১৫ ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগের সুযোগ ছিল। এখন কোলিস্টিন সালফেট ছাড়া আমাদের হাতে আর কোনো বিকল্প নেই। শুধু এ দুজনই নয়, আইসিইউতে ভর্তি রোগীদের অধিকাংশই কোনো না কোনো অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট। বর্তমানে বাজারে প্রচলিত ২০-২৫ ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়। আইসিইউর অধিকাংশ রোগীরই ২০টার মধ্যে অন্তত ১৮টা অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হয়ে রয়েছে। কিছু রোগী পাচ্ছি যাদের সব অ্যান্টিবায়োটিকই রেজিস্ট্যান্স।
ঝুঁকিতে রয়েছে শিশুরাও
শিশুরা নিয়মিত অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ না করলেও তাদের শরীরে মিলছে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স। চিকিৎসকরা ধারণা করছেন আমাদের চারপাশের পরিবেশে থাকা মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট জীবাণু তাদের শরীরে প্রবেশ করছে এবং শরীরে অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা কমিয়ে দিচ্ছে। ফলশ্রুতিতে ভবিষ্যতে ছোটখাটো রোগও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠতে পারে এবং মৃত্যু ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলতে পারে। মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট জীবাণু সাধারণত যথেচ্ছভাবে কৃষিপণ্যে বা পোলট্রি শিল্পে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগের কারণে তৈরি হচ্ছে এবং পরিবেশে এসে পড়ছে। এখন বাংলাদেশিও মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট জীবাণু ছড়িয়ে পড়ছে।
চিকিৎসকরা কী বলছেন
আইসিইউতে চিকিৎসাধীন কম-বেশি ২৫ শতাংশ রোগী অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। দীর্ঘদিন ধরে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সি নিয়ে কাজ করছেন বিএসএমএমইউর ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সায়েদুর রহমান। তিনি বলেন, বাংলাদেশে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সে বছরে কত মানুষ মারা যায় তার কোনো তথ্য নেই। সব অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স যে ব্যাকটেরিয়া তা সাধারণ ইনফেকশনে পাওয়া যায় না কিন্তু আইসিইউতে পাওয়া যায়। বিভিন্ন সময় গবেষণা করে আমরা দেখেছি, যেকোনো আইসিইউতে প্রায়ই সব ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স থাকে অন্তত ২৫ শতাংশ রোগীর। তখন অ্যান্টিবায়োটিক বন্ধ করে দেয়া হয় বা শক্তিশালী কোনো অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হয়। এ রোগীগুলোর জন্য বিকল্প কিছুই থাকে না। শুধু অপেক্ষা করা ছাড়া।
ডা. এ কে এম হাবিব উল্লাহ বলেন, অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার অনেক বেড়ে গেছে। ফার্মেসির দোকানদার, পল্লী চিকিৎসক থেকে শুরু করে সবাই অ্যান্টিবায়োটিক দিচ্ছে। কোন রোগের কোন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক কোন মেয়াদে দিতে হবে তা না জেনেই তারা অ্যান্টিবায়োটিক দিচ্ছে। এছাড়া চিকিৎসকরা ব্যবস্থাপত্রে যে অ্যান্টিবায়োটিক লিখছেন, রোগীরা পূর্ণমেয়াদে তা শেষ করছে না। ফলে তার শরীরে যে জীবাণু থাকছে তা ওই অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে রেজিস্ট্যান্স তৈরি করছে। আগামী ৫ থেকে ১০ বছর পর এ অবস্থা আরো ভয়াবহ হবে।
জানা গেছে, দেশের প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার ফার্মেসিতে ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি হয়। অনেক চিকিৎসক সামান্য অসুখে অ্যান্টিবায়োটিক দেন। বেশি দামের কারণে রোগীরা কিছুটা সুস্থ হলে অ্যান্টিবায়োটিকের মেয়াদ শেষ করে না। এর ফলে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স তৈরি হচ্ছে। দেশে গড়ে প্রতিদিন সাত লাখ মানুষ অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করে।
অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার বৃদ্ধির প্রমাণ পাওয়া যায় বাজারে এ ধরনের ওষুধ বিক্রির তথ্যেও। গত বছর দেশে দ্বিতীয় সর্বাধিক বিক্রীত ওষুধ ছিল সেফালোসপোরিন্স অ্যান্ড কম্বিনেশন বা অ্যান্টিবায়োটিক। এ শ্রেণীর ১ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকার ওষুধ বিক্রি হয় গত বছর। ওষুধটির বিক্রয় প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণে অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকর বলে সর্দি, কাশির মতো জীবাণুবাহিত সংক্রমণেও অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়।
অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি হাসপাতালের পরিবেশ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই বলে জানান চিকিৎসকরা। অধ্যাপক সায়েদুর রহমান বলেন, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স সমস্যা সমাধানে চিকিৎসক ও রাষ্ট্রকে নেতৃত্ব দিতে হবে। চিকিৎসকদের অতিরিক্ত দায়িত্ব রোগীকে অ্যান্টিবায়োটিকের ঝুঁকি সম্পর্কে বোঝানো। অযৌক্তিক কারণে চিকিৎসকরা অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করবে না। পাশাপাশি রাষ্ট্রকে কাজ করতে হবে, যাতে অপ্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি না হয়।
সুপার বাগ আতঙ্ক
বর্তমান সময়ে মানবদেহের হুমকিগুলোর মধ্যে সুপার বাগ অন্যতম। মানুষ, জীব জন্তু ও কৃষি ক্ষেত্রে অনিয়ন্ত্রিতভাবে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারে মাল্টিড্রাগ রেজিস্টেন্ট বা সুপার বাগ তৈরি হয়, অর্থাৎ যখন কোনো ব্যাকটেরিয়া একাধিক ড্রাগ রেজিস্টেন্স জিন বহন করে। বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া যে হারে ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে উঠছে সে তুলনায় নতুন অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়াও একটি নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারে যে সময় লেগে যায়, তার থেকে অনেক কম সময়েই ব্যাকটেরিয়া ওই অ্যান্টিবায়োটিকের রেজিস্ট্যান্স গঠন করে ফেলছে। এভাবে ক্রমাগত চলতে থাকলে সুপার বাগের প্রকোপ মানব জাতির জন্য রীতিমতো ভয়াবহ হয়ে দাড়াবে। এর থেকে পরিত্রানের একমাত্র উপায় অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগে আমাদের সচেতনতা।
লেখক: প্রতিবেদক, বণিক বার্তা