সোমবার ● ১ অক্টোবর ২০১৮
প্রথম পাতা » নোবেল পুরষ্কার: চিকিৎসা » ক্যান্সার থেরাপির নতুন তত্ত্ব উদ্ভাবনের জন্য ২০১৮ সালে চিকিৎসায় নোবেল
ক্যান্সার থেরাপির নতুন তত্ত্ব উদ্ভাবনের জন্য ২০১৮ সালে চিকিৎসায় নোবেল
প্রতি বছর বিশ্বে লাখ লাখ মানুষ ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করে এবং ক্যান্সার মানবজাতির জন্য এটি বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছে। চলতি বছরে ক্যান্সার থেরাপির এক নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করে চিকিৎসাবিজ্ঞানে যৌথভাবে নোবেল পুরষ্কার লাভ করলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানী জেমস পি. এলিসন ও জাপানের বিজ্ঞানী তাসুকু হনঝু। তাদের এই উদ্ভাবিত পদ্ধতিতে মানুষের শরীরের নিজস্ব রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে ক্যান্সার চিকিৎসায় অগ্রগতি সাধন করা সম্ভব হবে।
জেমস পি. এলিসন একটি পরিচিত প্রোটিন নিয়ে গবেষণা করেন যা আমাদের রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে বাধা দেয়ার কাজটি করে। তিনি দেখেন যে শরীরের এই প্রোটিন উপাদানকে রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থায় গতিরোধক হিসেবে ভূমিকা পালনে বাধা দিলে দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা টিউমারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে। এই ধারণাকে তিনি চিকিৎসায় থাকা রোগীদের ওপরে প্রয়োগ করলেন।
একইসাথে তাসুকু হনঝু আবিষ্কার করলেন আমাদের রোগ-প্রতিরোধ কোষগুলোর মধ্যে একটি প্রোটিন রয়েছে, অত্যন্ত নিবিড় পর্যবেক্ষণের পরে তিনি সম্ভাব্য ধারণা করলেন এটিও বাধা হিসেবে কাজ করে, তবে এটির কাজের বেলায় ভিন্ন কৌশল দেখতে পেলেন তিনি। তার প্রমাণিত আবিষ্কারের ভিত্তিতে উদ্ভাবিত থেরাপি ক্যান্সার প্রতিরোধে কার্যকরী ছিল। উভয় বিজ্ঞানী্ দেখিয়েছেন, মানুষের রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থায় এই বাধাগুলোকে ভেঙে ক্যানসার প্রতিরোধ করা যায়।
আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা কি ক্যান্সার চিকিৎসায় ভূমিকা রাখতে পারে?
সকল ধরনের ক্যান্সারেই অস্বাভাবিক কোষ বিভাজন ঘটে যা শরীরের সু্স্থ্য অঙ্গ ও কোষে বিস্তার লাভ করে ক্ষতিসাধন করে। ক্যান্সারের চিকিৎসায় তাই শুরুতেই এই বিস্তার রোধ করার জন্য নানা ধরনের থেরাপি রয়েছে, যার মধ্যে অস্ত্রোপচার, তেজস্ক্রিয় রশ্মি সহ অন্যান্য অনেক পদ্ধতিই রয়েছে। পদ্ধতিগুলোর কোনটি কোনটি উদ্ভাবনের জন্য পূর্বে নোবেল পুরষ্কারও লাভ করেছে। উদাহরন হিসেবে বলা যায়: প্রোষ্টেট ক্যান্সারের হরমোন চিকিৎসা (হাগিনস্, ১৯৬৬), কেমোথেরাপি (এলিয়ন ও হিচিন, ১৯৮৮) এবং লিউকোমিয়ার জন্য অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন (থমাস, ১৯৯০)। কিন্তু চিকিৎসাক্ষেত্রে নানা অগ্রগতির পরেও ক্যান্সারের চিকিৎসা এখনো অনেক কঠিন। উনিশ শতাব্দীর শেষভাগে এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে এই ধারণা বিস্তার লাভ করে যে দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে কার্যকর করে তোলার মাধ্যমে টিউমার কোষকে আঘাত করা সম্ভব। এমনকি এসময় দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে বাড়িয়ে তুলতে দেহে ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করানোর মতো পরীক্ষাও চালানো হয়েছিল। তবে এটি অনুমেয় ছিল চিকিৎসা পদ্ধতির উন্নতিতে আরও জ্ঞানের প্রয়োজন। বহু বিজ্ঞানী নিজেদের গবেষণায় নিয়োজিত করেন।
আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় গতিবর্ধক ও গতিরোধক
আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার মৌলিক বৈশিষ্ট্য বলা চলে ‘অপর’ থেকে ‘নিজ’ এর পার্থক্য নিরূপণ করতে পারার সক্ষমতা, যাতে করে দেহে আক্রমণকারী ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া এবং অন্যান্য ক্ষতিকর উপাদানকে প্রতিহত ও উচ্ছেদ করতে পারে। টি কোষ, এক ধরনের শ্বেত রক্তকণিকা এই প্রতিরোধ ব্যবস্থার প্রধান উপাদান। টি কোষের রিসিপটর রয়েছে যা দেহে প্রবেশ করা ‘অপর’ উপাদানের সাথে যুক্ত হয়ে দেহ থেকে উচ্ছেদ করে। রিসিপটরের এই যুক্ত হওয়ার ক্ষমতাই রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থার সক্রিয়তার নির্দেশক। আমাদের দেহের মধ্যে এমনকিছু প্রোটিন রয়েছে, যা টি কোষের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে, যা গতিবর্ধক হিসেবে চিহ্নিত। আবার কিছু প্রোটিন কার্যকারিতা হ্রাস করে দেয়, যা গতিরোধক হিসেবে চিহ্নিত। এটা নিশ্চিত করে যে, রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থা ক্ষতিকর জীবাণু প্রতিহত করে যখন অতি সক্রিয়তার কারণে দেহের সুস্থ্য কোষ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
রোগ-প্রতিরোধ থেরাপির জন্য একটি নতুন তত্ত্ব
১৯৯০ সালে জেমস পি. এলিসন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তার গবেষণাগারে টি-কোষের প্রোটিন সিটিএলএ-৪ পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি ছিলেন গুটিকয়েক বিজ্ঞানীদের মধ্যে একজন যিনি পর্যবেক্ষণ করেছিলেন সিটিএলএ-৪ টি-কোষে গতিরোধক হিসেবে কাজ করে। কিন্তু অন্য গবেষকেরা সিটিএলএ-৪ নষ্ট করে স্বয়ংক্রিয় প্রতিরোধব্যবস্থার তত্ত্ব দেন। কিন্তু এলিসনের সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারণা ছিল। তিনি ইতিমধ্যেই একটি অ্যান্টিবডি আবিষ্কার করেন, যা সিটিএলএ-৪-এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাকে অকার্যকর করে দিতে পারে। এলিসন ও তার সহকারীরা ১৯৯৪ সালের শেষের দিকে এই পদ্ধতির প্রথম পরীক্ষা করেন এবং তাদের উত্তেজনা এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকে যে তারা বড়দিনের ছুটিতে পরীক্ষাটি পুনরায় করেন। পরীক্ষার ফলাফল ছিল লক্ষণীয়। ক্যান্সার আক্রান্ত ইঁদুরগুলো এই অ্যান্টিবডির সাহায্যে সুস্থ্য হয়ে উঠল। যদিও তার এই গবেষণার প্রতি ওষুধশিল্পের খুব একটা আগ্রহ দেখা যায়নি, কিন্তু এলিসন মানুষের প্রয়োগযোগ্য একটি পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য গবেষণা চালিয়ে যেতে থাকেন। ২০১০ সালে তিনি মেলানোমা নামের একটি ত্বকের ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর ওপর এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে সাফল্য লাভ করেন। এই ধরনের সাফল্যজনক ফলাফল এর আগে পাওয়া যায়নি।
পিডি-১ আবিষ্কার এবং ক্যান্সারের থেরাপিতে এর গুরুত্ব
১৯৯২ সালে, এলিসনের আবিষ্কারের কয়েক বছর পূর্বে তাসুকু হনঝু টি-কোষের পৃষ্ঠে পিডি-১ নামের এক প্রোটিন আবিষ্কার করেন। পিডি-১ এর ভূমিকা উন্মোচন করতে তিনি কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ে তার গবেষণাগারে কয়েক বছর ধরে কতগুলো দক্ষ পরীক্ষা চালান। পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যায়, পিডি-১ প্রোটিন সিটিএলএ-৪ এর মতোই টি-কোষ গতিরোধক হিসেবে কাজ করে, কিন্তু ভিন্ন কৌশলে। প্রাণীদেহের ওপরে পরীক্ষায় দেখা যায়, পিডি-১ ক্যান্সারের বিরুদ্ধে দারুণ কার্যকর। হনঝু ২০১২ সালের এর সফল প্রয়োগ করেন।
আজ এবং আগামীর জন্য ক্যান্সারের ইমিউন চেকপয়েন্ট থেরাপি
সিটিএলএ-৪ ও পিডি-১ প্রোটিনকে অবরুদ্ধ করার ফলাফল প্রাথমিক গবেষণায় পাওয়া গিয়েছে। এই চিকিৎসা পদ্ধতিকে ‘ইমিউন চেকপয়েন্ট থেরাপি’ও বলা হয়, যার মাধ্যমে গুরুতর ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় অনেক অগ্রগতি হয়েছে। ক্যান্সারের অন্যান্য থেরাপির মতো এরও বৈরি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে এবং এগুলো এমনকি প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে। অতি সক্রিয় রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থায় সাড়া জাগায় এমনটি ঘটে, যা স্বয়ংক্রিয় প্রতিরোধব্যবস্থা পরিচালিত করে। তবে এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে করা সম্ভব।
কয়েক ধরনের ক্যান্সারের ওপর গবেষণায় এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত এই দুই পদ্ধতির মধ্যে পিডি-১ এর বিরুদ্ধে চেকপয়েন্ট থেরাপি বেশি কার্যকর হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। নতুন গবেষণা ইঙ্গিত করছে সিটিএলএ-৪ ও পিডি-১ উভয়ে একত্রিতভাবে অধিক কার্যকরী হতে পারে।
জেমস পি. এলিসন ১৯৪৮ সালের ৭ আগস্ট, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৩ সালে তার পিএইচডি সম্মন্ন করেন। ১৯৭৪-১৯৭৭ পর্যন্ত তিনি ক্যালিফোর্ণিয়ার স্ক্রিপস্ ক্লিনিক এন্ড রিসার্চ ফাউন্ডেশনের পোস্টডক্টরাল ফেলো ছিলেন, ১৯৭৭-১৯৮৪ পর্যন্ত টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের সিস্টেম ক্যান্সার সেন্টারের ফ্যাকাল্টি সদস্য ছিলেন। ২০১২ সাল পর্যন্ত তিনি টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের এমডি অ্যান্ডারসন ক্যান্সার সেন্টারের অধ্যাপক হিসেবে ছিলেন।
তাসুকু হনঝু ১৯৪২ সালের ২৭ জানুয়ারি জাপানের কিয়োটোতে জন্মগ্রহণ করেন।১৯৭৪-১৯৭৯ পর্যন্ত তিনি টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় ও ১৯৭৯-১৯৮৪ পর্যন্ত তিনি ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি সদস্য ছিলেন। এছাড়া ১৯৮৪ সাল থেকে তিনি কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে নিয়োজিত। তিনি ১৯৯৬-২০০০ ও ২০০২-২০০৪ পর্যন্ত কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি ডীন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।