সোমবার ● ১৪ মে ২০১৮
প্রথম পাতা » অর্জন/সাফল্য » নতুন অর্কিড পেল বাংলাদেশ - সৌরভ মাহমুদ
নতুন অর্কিড পেল বাংলাদেশ - সৌরভ মাহমুদ
বাংলাদেশের বন-বাদাড়ে প্রায় ১৭৮ প্রজাতির অর্কিড জন্মে (সূত্র : বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ, খণ্ড-১২)। এ তালিকায় যুক্ত হল আরেকটি নতুন প্রজাতি। রাজশাহী অঞ্চলের প্রাকৃতিক ঘাসবনে এ প্রজাতির অর্কিড ফুল দেখা যায় ২০০৮ সালে। প্রজাতিটি কোনো উদ্ভিদ গবেষকের দৃষ্টিগোচর না হওয়ায় এ পর্যন্ত শনাক্ত হয়নি। ২০১৪ সালের জুনে এ অর্কিডের খোঁজে রাজশাহী গিয়ে প্রায় ২০টি অর্কিডে ফুল দেখতে পাই। ফুলের নমুনা সংগ্রহ করি, ছবি তুলি এবং ঢাকায় ফিরে নমুনা ও ছবি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. আবুল হাসান এবং ড. জসীম উদ্দিনকে দেখাই। এর পর দুটি নমুনা উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের হার্বেরিয়ামে ও বাংলাদেশ জাতীয় হার্বেরিয়ামে জমা দিই। তারপর ভারতের বিখ্যাত অর্কিড গবেষেক পঙ্কজ কুমারকে ছবি পাঠিয়ে কথা বলি, তিনি জানান- এটি নতুন কোনো প্রজাতি হবে ইউলোফিয়াগণের। তিনি আমাকে এ অর্কিডের পাতার ডিএনএ পরীক্ষা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে বলেন। ২০১৫ সালে পাতা সংগ্রহ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের জৈবরসায়ন এবং আণবিক জীববিজ্ঞান বিভাগে গিয়ে জানতে পারি ডিএনএ পরীক্ষা করা যাবে না। ইতিমধ্যে লন্ডনের বিখ্যাত কিউ বোটানিক গার্ডেনের অর্কিড বিশেষজ্ঞ এন্ড্রি হ্যুয়েটিম্যান (Andre Schuiteman) এর সঙ্গে যোগাযোগ করি এবং নমুনা পাঠাই। প্রায় দুই মাস পর তিনি অজানা এ অর্কিড শনাক্ত করেন ইউলোফিয়া অবটিউজা (Eulophia obtusa) হিসেবে। বাংলাদেশে নতুন এ প্রজাতিটি নিয়ে আমার একটি যৌথ গবেষণাপত্র সম্প্রতি স্প্রিঙ্গার জার্নালের অন্তর্ভুক্ত কিউ বুলেটিনের জুন ২০১৭ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। কিউ হার্বেরিয়ামে ১৯০২ সালে ভারত থেকে সংগৃহীত নমুনা, প্রকাশিত এবং অপ্রকাশিত গবেষণাপত্র বিশ্লেষণ এবং একটি আঁকা ছবি প্রজাতিটি শনাক্ত করতে বিশেষ অবদান রাখে। গত ১০০ বছরে প্রাকৃতিক আবাসে এ প্রজাতিটি দেখা যায়নি এবং কোনো ছবিও তোলা সম্ভব হয়নি। যে কারণে প্রজাতিটিকে অতি দুর্লভ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। এ অর্কিড প্রজাতি সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য জানা ছিল না। ১৮৩৩ সালে ভারতের উত্তরখাণ্ড থেকে প্রথম এটির বর্ণনা পাওয়া যায়। ১৯০২ সালে গঙ্গা অববাহিকায় এটি পাওয়া গিয়েছিল। দক্ষিণ ভারতে আঠারো শতকের দিকে পাওয়া গিয়েছিল এমন তথ্য আছে। বাংলাদেশে এটির উপস্থিতির কোনো তথ্য ও প্রকাশনাও নেই। ২০১৩ সালে আসামের চিরাং রিজার্ভ ফরেস্ট এবং নেপাল থেকে পাওয়া গেছে বলে তথ্য রয়েছে, তবে এটির কোনো নমুনা ও ছবি গবেষকরা দেখাতে সক্ষম হননি। গত ১০০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ থেকেই দুর্লভ এ প্রজাতিটির নমুনা ও ছবি এবং নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া গেল।
আইইউসিএনের রেডলিস্ট অনুসারে বাংলাদেশে নতুন আবিষ্কৃত প্রজাতিটিকে মহাবিপন্ন উদ্ভিদ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধে বলা হয়েছে- বাংলাদেশে আবিষ্কৃত এ অর্কিড প্রজাতিটি বিলুপ্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
বাংলাদেশে যেখানে এ উদ্ভিদটি জন্মে সেই স্থান বহুকাল ঘাসবন ছিল। শুধু শীতের সময় খড় কাটা হতো। বর্ষা এলেই ঘাসের সঙ্গে অর্কিড চারা গজিয়ে বড় হতো এবং ফুল ফুটত। গ্রামের মানুষ ঘাসবনে এ সুন্দর ফুলের গুরুত্ব হয়তো কোনোদিন বুঝতেই পারেনি। পাতা অবিকল ঘাসের মতো। তাদের কাছে হয়তো এটি ঘাসফুল নামেই পরিচিত ছিল।
২০১৫ সালে স্থানীয় এক কৃষক মালিকের কাছ থেকে জমি ঠিকা নিয়ে সবজি চাষের পরিকল্পনা করেন। সেই বছর প্রায় ৭ থেকে ১০ কেজির মতো কন্দ বা বিছন (স্থানীয় ভাষায় বিছন) নষ্ট হয়ে যায় লাঙল দিয়ে জমি চাষের কারণে। কিছু কন্দ জমির চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সেই বছর জমি চাষ করার পরও সবজি চারা মধ্যে ৩১০টি চারা গজিয়েছিল বেঁচে যাওয়া কন্দ থেকে। কিন্তু ফুল ফোটেনি। আমি সেখান থেকে দুটি চারা সংগ্রহ করে ঢাকায় এনে টবে লাগাই। ২০১৬ সালে টবে থাকা কন্দ থেকে কয়েকটি চারা গজায় যার দুটি মিরপুরে জাতীয় উদ্ভিদ সংগ্রহশালার বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার অনুমতিক্রমে নির্বাচিত জায়গায় রোপণ করি। চারা দুটি বড় হচ্ছে। আমার বাসার টবেও এ বছর আরও দুটি চারা গজিয়েছে।
২০১৫ সালে নষ্ট করা ঘাসবনে সবজি চাষ বন্ধ করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে স্থানীয় কৃষকদের নিয়ে কাজ শুরু করি। অনেক চেষ্টার পরও চারা গজানোর হার কমে যাচ্ছে। ২০১৭ সালে মাত্র ৬-৭টি চারা গজিয়েছে। বর্তমানে মাত্র ০.৮ হেক্টর জায়গায় এ অর্কিড জন্মে। জমির তিন দিকেই আবাদি জমি।
দুর্লভ, সুন্দর ফুলের এ অর্কিড প্রজাতিটি বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে! প্রজাতিটি সংরক্ষণ করার জন্য বাংলাদেশ বন বিভাগ এবং উদ্ভিদ গবেষক ও প্রকৃতিপ্রেমীরা উদ্যোগী হবেন এমনটাই প্রত্যাশা।