বৃহস্পতিবার ● ৯ জানুয়ারী ২০২০
প্রথম পাতা » বিজ্ঞান সংবাদ: রসায়ন » নিঃশ্বেষ হতে পারে যেসকল মূল্যবান ধাতু
নিঃশ্বেষ হতে পারে যেসকল মূল্যবান ধাতু
নিত্য নতুন প্রযুক্তির প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয় বিভিন্ন রকমের ধাতু। প্রয়োজন বা বিলাসিতা যে কারণেই হোক বর্তমানে অন্যতম ব্যবহৃত প্রযুক্তি স্মার্টফোন। একটি স্মার্টফোনেই প্রায় ৩০ ধরনের উপকরণ রয়েছে এবং এর মধ্যে অনেকগুলোই দুর্লভ। প্রকৃতিতে প্রাপ্ত এসকল ধাতুর ভাণ্ডার অফুরান নয়। বিজ্ঞানীরা শঙ্কা প্রকাশ করছেন আগামী ১০০ বছরের মধ্যে পৃথিবী থেকে উধাও হয়ে যাবে বেশ কয়েকটি মূল্যবান ধাতু। স্মার্টফোনে এরকম অত্যাবশ্যকীয় দুটো ধাতু ইন্ডিয়াম ও ট্যান্টালাম।
ইন্ডিয়াম ধাতুটি ইন্ডিয়াম টিন অক্সাইড নামের একটি অনন্য যৌগ হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যা টাচ স্ক্রিনের জন্য অত্যাবশ্যক, কারণ এটি স্বচ্ছ ও বিদ্যুত পরিবহন করে। এটি সৌরপ্যানেলেও ব্যবহৃত হয়। কাজেই ভবিষ্যতে এই ধাতুর ব্যাপকভাবে প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু পৃথিবীতে এই ধাতুটির মজুদ পর্যাপ্ত নয় এবং প্রকৃতি থেকে মাত্র কয়েক মিলিগ্রাম ইন্ডিয়াম পেতে প্রায় কিলোখানেক আকরিক প্রয়োজন হয়।
অনেকেরই হয়তো ট্যান্টালাম ধাতুটির নাম জানা নেই । এর তীব্র ক্ষয়রোধী ক্ষমতার কারণে ফোনের মতো ছোট ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসের জন্য উপযুক্ত। পাশাপাশি এটি পেসমেকার, শ্রবণ যন্ত্র প্রভৃতির জন্য বেশ উপযোগী। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন ইন্ডিয়াম ও ট্যান্টালাম খনি আগামী ১০০ বছরের মধ্যে নিঃশ্বেষ হয়ে যাবে। কিন্তু নতুন প্রযুক্তির জন্য আমাদের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। এমনকি তারে ব্যবহৃত তামাও পর্যাপ্ত পরিমাণে নেই।
স্মার্ট ফোনের যে উপাদানগুলি আগামী ১০০ বছরের মধ্যে শেষ হতে পারে তার মধ্যে:
গ্যালিয়াম: চিকিত্সা থার্মোমিটার, এলইডি, সোলার প্যানেল, টেলিস্কোপগুলিতে ব্যবহৃত হয় এবং ক্যান্সারবিরোধী সম্ভাব্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে;
আর্সেনিক: কাঠ সংরক্ষণকারক হিসাবে ও আতশবাজি ব্যবহৃত হয়;
সিলভার: আয়না, প্রতিক্রিয়াশীল লেন্সগুলি যা সূর্যের আলোতে অন্ধকার করে, টাচ স্ক্রিনের সাথে ব্যবহারের জন্য অ্যান্টিব্যাক্টেরিয়াল পোশাক এবং গ্লাভস তৈরিতে;
ইন্ডিয়াম: ট্রান্সজিস্টার, মাইক্রোচিপস, ফায়ার-স্প্রিংকলার সিস্টেমে, সোলার প্যানেলে, ফর্মুলা ওয়ান গাড়িতে বল-বিয়ারিংয়ের আবরণ হিসাবে ব্যবহৃত হয়;
ইট্রিয়াম: সাদা এলইডি লাইট, ক্যামেরা লেন্স এবং কিছু ক্যান্সারের চিকিত্সার জন্য ব্যবহার করা হয়;
ট্যান্টালাম: সার্জিক্যাল ইমপ্ল্যান্টস, নিয়ন লাইটের জন্য ইলেক্ট্রোড, টারবাইন ব্লেড, রকেট অগ্রভাগ এবং সুপারসনিক বিমানের নোস ক্যাপ, হিয়ারিং এইডস এবং পেসমেকারে ট্যান্টালাম বহুল ব্যবহৃত।
সভ্যতার উন্নতির সাথে সাথে আরও বেশি চাহিদা বাড়বে এদের। সেই দাবি মেটাতে গিয়ে প্রকৃতি ক্রমাগত নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। ক্রমবর্ধমান ও অদৃশ্য পৃথিবীর এসব বিরল উপাদানগুলির সংকট নিয়ে রয়্যাল সোসাইটি অফ কেমিস্ট্রি একটি জরিপ চালিয়েছিল, যার উদ্দেশ্য ছিল ঠিক কতটা অব্যবহৃত প্রযুক্তি আমরা সকলেই মজুদ করছি তার ধারণা লাভ করা। যুক্তরাজ্যে দুই সহস্রাধিক লোকের ওপর পরিচালিত অনলাইন জরিপে দেখা যায় অর্ধেক পরিবারের কমপক্ষে একটি অব্যবহৃত ইলেকট্রনিক ডিভাইস ছিল এবং ৪৫% বাড়িতে দুটি থেকে পাঁচের মধ্যে অব্যবহৃত ইলেকট্রনিক ডিভাইস রয়েছে। বেশিরভাগ লোক স্বীকার করেছে যে তাদের সংগ্রহটি পুনর্ব্যবহার করার কোনও পরিকল্পনা ছিল না। জরিপের হিসেব মতে যুক্তরাজ্যেই প্রায় চার কোটি অব্যবহৃত ডিভাইস বাড়িতে মজুদ রয়েছে।
পৃথিবীর সকল স্থানে এখনো ই-বর্জ্য রিসাক্লিংয়ের যথেষ্ট সুব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি, তাই বিপুল পরিমাণে অব্যবহৃত ডিভাইস ই-বর্জ্য হিসেবেই জমে থাকছে। এক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা বিরল মৌলের বিলুপ্তি ঠেকাতে পরামর্শ দিচ্ছেন ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস ব্যবহার কমাতে ও পুণঃব্যবহার করতে বা রিসাইক্লিং করতে পাঠিয়ে দেওয়া। সেক্ষেত্রে নিত্য নতুন স্মার্টফোন, ল্যাপটপ বদলে না ফেলে একটু সময় নিয়ে ব্যবহার করা, বাড়িতে অব্যবহৃত ডিভাইস ফেলে না রেখে অন্যকে ব্যবহার করতে দেওয়া বা দান করা, একইসাথে সম্ভব হলে অপ্রয়োজনীয় বা বাতিল ডিভাইসগুলো ফেলে না দিয়ে রিসাইক্লিং পয়েন্টে পাঠিয়ে দেওয়া যেতে পারে। প্রযুক্তি ব্যবহারে এখনি সচেতন না হলে অদূর ভবিষ্যতে মৌল ঘাটতির কারণে সভ্যতার সঙ্কট হিসেবে নতুন বিপত্তি উপস্থিত হতে সময় লাগবে না।
লুপ্তপ্রায় মৌলেরা সমস্বরে একদিন ‘হারিয়ে গেছি আমি’ বলার আগে মানবজাতিকেই সচেতন উদ্যোগ নিতে হবে। আপনি বছরে দু’বার ফোন, দু’বছরে একবার ল্যাপটপ বদলে ফেলেন, আপনার বাবা পেসমেকার বুকে নিয়ে দিব্যি আরামে থাকেন। সেই আপনিই যদি এক দিন দেখেন বাজারে আর সেই সব পাওয়া যাচ্ছে না, কারণ সব প্রয়োজনীয় মৌল নিঃশেষিত হয়ে গিয়েছে, সে দিন কিন্তু পর্যায়সারণি একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বাস্তব। সেটি যেন আগামীতে নিছক ইতিহাসে পরিণত না হয়, চলুন আজ সবাই মেন্ডেলিভের কাছে সেই প্রতিজ্ঞাই রাখি।
সূত্র: বিবিসি