

বুধবার ● ২৫ ফেব্রুয়ারী ২০১৫
প্রথম পাতা » মঙ্গলে আবাস » মঙ্গল জয়ের হাতছানি
মঙ্গল জয়ের হাতছানি
টাইম ম্যাগাজিনের জোয়েল স্টেইন তার এক কলামে বলেছেন, মঙ্গলের এই অভিযাত্রা অন্য যে কোনো মহাকাশ অভিযানের চেয়ে আলাদা। যারা উড়ে যাবে মঙ্গলের উদ্দেশে তারা আর কোনোদিন ফিরতে পারবেন না পৃথিবীতে। এজন্যই বলা হচ্ছে, ‘ওয়ানওয়ে’ টিকিট। আর এই পথ পাড়ি দিতে তৃতীয় রাউন্ডে ১০০ জন নির্বাচিত হয়েছেন। এদের মধ্যে চারজন ২৩ সালে মঙ্গলের দিকে যাত্রা করবেন
নেদারল্যান্ডসভিত্তিক বেসরকারি মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান মার্স ওয়ান। এই সংস্থা মঙ্গলগ্রহে মনুষ্য বসতি গড়ার লক্ষ্যে ২০১৩ সাল থেকে নিয়মিত কার্যক্রম শুরু করে। নানা অনিশ্চয়তা আর বিতর্কের ঝড় উঠলেও থেমে থাকেনি তাদের প্রচেষ্টা। বরং আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম ঘোষণার পাঁচ মাসের মধ্যেই মার্স ওয়ান মিশনের জন্য ১৪০ দেশের ২০২,৫৮৬টি আবেদনপত্র জমা পড়েছিল। মহাকাশই হবে আমাদের পরবর্তী ঠিকানা এমন দাবিকেই প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে মার্স ওয়ান কর্তৃপক্ষ কয়েকটি পর্যায়ে প্রার্থী বাছাইয়ের মাধ্যমে সম্প্রতি তৃতীয় রাউন্ডের জন্য ১০০ জন প্রার্থীর মনোনয়ন চূড়ান্ত করেছে।
পৃথিবীর অর্ধেক ব্যাসার্ধের এবং এক-দশমাংশ ভরের লাল প্রতিবেশী মঙ্গলগ্রহকে ঘিরে বিজ্ঞানীদের কৌতূহল দীর্ঘদিনের। সৌরজগতের মধ্যে পৃথিবীর বাইরে প্রাণের বিকাশ মঙ্গলেই ঘটেছিল এমন ধারণা অতীত থেকেই বিজ্ঞানীদের ঔৎসুক্য করে তুলেছিল। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার মেরিনার-৪ মহাকাশযান ১৯৬৪ সালে প্রথমবারের মতো মঙ্গলে ফ্লাই-বাই করতে সমর্থ হয়। এই ধারাবাহিকতায় যুক্ত হয়েছিল মার্স-২, ৩; ভাইকিং-১, ২; ফোবোস ১, ২; মার্স এক্সপ্রেস অরবিটার, বিগল ২, স্পিরিট ও অপরচুনিটি, ফিনিক্স মার্সল্যান্ডার প্রভৃতি মিশন। কিন্তু সবকিছুতে ছাপিয়ে বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছে মার্স ওয়ান মিশন। অবিশ্বাস্য চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে তারা ২২ এপ্রিল, ২০১৩ তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু করে।
মার্স ওয়ানের তৃতীয় পর্যায়ের নির্বাচনে মোট ৬৬০ জনের অনলাইন ইন্টারভিউ নেওয়া হয়েছিল। তাদের ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা, দলগত কাজের মানসিকতা, জীবনধারায় পরিবর্তনকে ধারণ করা প্রভৃতি বিচারে সেরা ১০০ জনের মধ্যে ৫০ জন পুরুষ ও ৫০ জন নারী জায়গা করে নেন। তাদের মধ্য ৩৯ জন মার্কিন, ৩১ ইউরোপিয়ান, ১৬ এশিয়ান, ৭ আফ্রিকান ও ৭ জন ওশেনিয়ান। তাদের মধ্য থেকে চূড়ান্ত পর্বের প্রার্থীদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেওয়ার পর ২০২৪ সালে একসঙ্গে ৪ জন করে নভোচারী পাঠানো শুরু করবে মার্স ওয়ান।
মার্স ওয়ানের সহ-প্রতিষ্ঠাতা বাস ল্যান্সডর্প জানান, বিপুলসংখ্যক প্রার্থীর মধ্য থেকে মার্স ওয়ানের জন্য যোগ্য অভিযাত্রী বেছে নেওয়ার প্রক্রিয়াটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই মঙ্গলচারী মানুষই বিশ্বকে এক নজরে জানিয়ে দেবে কে হবে আধুনিক সময়ের অভিযাত্রী।
মার্স ওয়ান কর্তৃপক্ষ প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তাদের নানাবিধ যোগ্যতা আমলে এনেছে। বিশেষ করে তাদের শারীরিক ও মানসিক সামর্থ্য। এ ছাড়া ব্যক্তিগত পর্যায়ে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এই কার্যক্রমের ও প্রকল্পের জন্য যথাসাধ্য প্রচারণার দক্ষতাকেও বিবেচনা করা হয়। নির্বাচিত প্রার্থীদের পরিবার ও বন্ধুবান্ধবদের কাছে বিষয়টি ইতিবাচকভাবে উপস্থাপনের জন্য বলা হয়েছিল, কারণ বিপদসঙ্কুল এই মহাকাশ অভিযাত্রায় প্রিয়জনদের কাছে কখনও ফিরে আসা সম্ভব হবে না, এই যাত্রা হবে শুধুই একমুখী। একবার পৃথিবীর বাতাবরণ কাটিয়ে গেলে এই সবুজ গ্রহে আর ফিরে আসা সম্ভব নয় জেনেও মঙ্গলের এই একমুখী যাত্রায় অভিযাত্রীদের আগ্রহের কমতি নেই। মার্স ওয়ান ওয়েবসাইটে আপলোড করা প্রার্থীদের ব্যক্তিগত মতামতের ভিডিওতে মানবিক সভ্যতা বিকাশের এই যাত্রায় শামিল হওয়ার মানসিক দৃঢ়তা যেন আবারও জানিয়ে দেয় আবিষ্কার আর জয়ের অদম্য নেশা এবং নিজ মেধাকে কাজে লাগিয়ে সভ্যতার বিনির্মাণ মানুষের এক আদিমতম প্রবৃত্তি।
উল্লেখ্য, দ্বিতীয় রাউন্ডের জন্য নির্বাচিত ১০৫৮ জন প্রার্থীর মধ্যে তিনজন বাংলাদেশি স্থান পেয়েছিলেন : সালমা মেহের ঐশী (২৭), শারমিন জাহান (২৫) এবং লুলু ফেরদৌস (৩৫)। যদিও সেরা একশ’তে তারা কেউই আর মনোনীত হননি। তবে মার্স ওয়ানের এই প্রথম যাত্রায় শেষাবধি কোনো বাংলাদেশির ঠাঁই না হলেও এ দেশের তরুণদের চ্যালেঞ্জ জয়ের মানসিকতার কোনো কমতি নেই এবং হয়তো অনাগত ভবিষ্যতে লালগ্রহে ঠিকই বাংলাদেশি অভিযাত্রীর পদচারণা থাকবে।
এখনও পর্যন্ত মঙ্গলে জীবনের খোঁজে অনুসন্ধান চালিয়ে বাসযোগ্য কোনো পরিবেশের সম্ভাবনা মেলেনি। গ্রহটি জীবনধারণের জন্য মোটেও অনুকূল নয়। মঙ্গলে নেই কোনো চৌম্বকীয় ক্ষেত্র, শুধু যৎসামান্য যে বায়ুমণ্ডল রয়েছে সেখানে প্রাণের অস্তিত্ব থাকা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এ ছাড়া মঙ্গলের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি পৃথিবীর সাপেক্ষে প্রায় দশ ভাগের এক ভাগ মাত্র। এ সত্ত্বেও মার্স ওয়ান মিশন শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ হিসেবে একের পর এক বাছাই প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখে এই মিশনের সফলতার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।
মার্স ওয়ান কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে তারা এ বছরেই আবার নতুন করে অভিযাত্রীদের জন্য আবেদন প্রক্রিয়া শুরু করবেন। এর মাধ্যমে কয়েকটি পর্যায়ে আবারও প্রার্থী বাছাই করা হবে। এতে করে বর্তমান বাছাইয়ে যারা রয়েছেন তারা পরবর্তীতে দলগতভাবে বাদ পড়লে নতুন অভিযাত্রীদের দিয়ে স্থান সঙ্কুলান করা হবে। তবে এখনও বিশ্ব অপেক্ষায় আছে এই অগস্ত্য যাত্রা সত্যিই কি সফলতার মুখ দেখবে নাকি মার্স ওয়ান শুধু কল্পকাহিনী হয়েই থাকবে বা মানুষের বর্তমান অক্ষমতা মেনে নিয়ে আরও দীর্ঘসময়ের অপেক্ষার প্রহর গুনতে হবে। ২০২৩ সালে মঙ্গলগ্রহে মানুষের প্রথম পদচারণার এই প্রচেষ্টা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য জ্ঞানচর্চার পবিবেশ ও প্রাযুক্তিক বিকাশের পথকে সুগম করবে সেটি সুনিশ্চিত। মহাবিশ্বে মানুষের দীর্ঘযাত্রার ক্ষেত্রে মঙ্গলই হয়তো হবে প্রথম পা ফেলার জায়গা।