শনিবার ● ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১১
প্রথম পাতা » সাক্ষাৎকার » কার্ল সাগানের সাক্ষাৎকার
কার্ল সাগানের সাক্ষাৎকার
১৯৯১ সালের শেষের দিকে বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল সাগান ‘নেহেরু স্মারক বক্তৃতা’ দিতে ভারত এসেছিলেন। এইসময় তিনি মানব অস্তিত্ব বিষয়ে আধ্যাত্মিক ও সংসদীয় নেতাদের এক বিশ্ব সম্মেলনেও ভাষণ দিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে ভারতের বিজ্ঞান জগতের বিভিন্ন বিষয়ে মত বিনিময় করেছিলেন। সাগান তাঁর আলোচনায় একদিকে যেমন মহাকাশ গবেষণার অগ্রগতি সম্পর্কে অবহিত করেন, অন্যদিকে তেমনি বিশ্ব পরিবেশের উদ্বেগজনক অবস্থা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন। তিনি তাঁর ভাষণে, ওজোন স্তরের অবক্ষয়, গ্রীন হাউজ গ্যাস তৈরি ও দ্রুত অরণ্য নির্মূল হওয়া প্রতিরোধে বিশ্বব্যাপী সহযোগিতার আহ্বান জানান। তাঁর মতে, কোন একটি দেশ এইসব সমস্যার জন্য এককভাবে দায়ী নয় এবং এককভাবে কোন দেশের পক্ষে তার মোকাবিলা করাও সম্ভব নয়। আমাদের কাজ করতে হবে একসাথে।
কার্ল সাগানের সাক্ষাৎকার নেবার জন্য ‘স্প্যান’ (ভারতস্থ মার্কিন দূতাবাসের মুখপত্র) পত্রিকার পক্ষ থেকে পুনের ইন্টার ইউনিভার্সিটি সেন্টার যার অ্যাস্ট্রোনমি এন্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের ডিরেক্টর ড. বিষ্ণু নারলিকারকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। দুই বিশ্বখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী মুখোমুখি বসে আলোচনা করেন তাঁদের প্রিয় বিষয়গুলো নিয়ে। এই আলোচনায় স্থান পেয়েছিল মহাকাশ গবেষণার বর্তমান পর্যায়, পৃথিবীতে জীবনের উদ্ভব, বহির্বিশ্বে জীবনের সন্ধান ও অন্যান্য বহু বিষয়।
জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকার : আপনার মনে আছে হয়তো আজ থেকে কুড়ি বছর আগে, আপনি আমাকে নিউইয়র্কের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রহ সম্পর্কিত বিভাগের ড. বিষ্ণু খারে-র গবেষণাগারে নিয়ে গিয়েছিলেন।
কার্ল সাগান : হ্যাঁ, মনে আছে, ড. খারেবেং আমি আজও একইসঙ্গে কাজ করে চলেছি।
নারলিকার : আপনি সেইসময় যে সব গবেষণা করছিলেন, তার কয়েকটি আমাকে দেখিয়েছিলেন। সুতরাং শুরুতেই আমি জানতে চাই, বর্তমানে সেখানে কি ধরনের কাজ চলছে?
সাগান : শনির সবচেয়ে বড় যে চাঁদ বা উপগ্রহ, সেই ‘টাইটান’ এর আবহমন্ডলের অনুরূপ পরিবেশে গবেষণাগারে সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে দারুণ সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। কোন উপগ্রহের বিশেষ বৈশিষ্ট্যই হল, এর আবহমন্ডল খুব ঘন এবং কুয়াশাপূর্ণ। ফলে পৃষ্ঠদেশকে দেখাই যায় না। ১৯৮০-৮১ সালের ভয়েজার-২ মহাকাশযানটি যখন টাইটানের পাশ দিয়ে গিয়েছিল তখনই জানা যায় যে, টাইটানের পৃষ্ঠদেশকে ভালোভাবে দেখা সম্ভব নয়। তবে আমরা সেই অভিযান থেকে জানতে পেরেছি, টাইটানের অবহমন্ডলে রয়েছে অসংখ্য জৈব গ্যাস। আর টাইটানের পৃষ্ঠদেশের অস্পষ্টতার কারণ যে হালকা লাল রঙের কণাগুলি রয়েছে সেগুলির ধর্মও আমরা খুঁজে বের করেছি।
আমরা অতি সম্প্রতি গবেষণাগারে টাইটানের আবহমন্ডলের প্রধান উপাদান - মিথেন ও নাইট্রোজেনকে খুব কম চাপে একসঙ্গে মিশ্রিত করেছি। তারপর শনির চৌম্বক ক্ষেত্রের মধ্যে আটকে থাকা ইলেকট্রনের অনুরূপ আহিত কনা দিয়ে সেই মিশ্রিত গ্যাসকে বিকিরিত করা হয়েছে। এটা করা হয়েছে কারণ, টাইটান শনির পাশ দিয়ে ঘোরার সময় টাইটানের আবহমন্ডলে এসে প্রবেশ করে ইলেকট্রনসমূহ।
টাইটানের আবহমন্ডলের অনুরূপ পরিবেশ তৈরি করতে গিয়ে আমরা পেয়েছি গ্যাস পর্যায়ে বিভিন্ন পদার্থ, আসলে সগুলি জৈব অনু। মিশ্রিত উপাদানের কার্বন, নাইট্রোজেন ও হাইড্রোজেনের পরমানু নিয়েই তৈরি এই জৈব অনুগুলি। সেইসঙ্গে যে পাত্রের মধ্যে এই গ্যাস মিশ্রিত করা হয়েছে তার গায়ে দেখা গেছে হালকা লাল-বাদামী রঙের লবনের গুড়া। আমরা মিলিয়ে দেখেছি, টাইটানের আবহমন্ডলের যে জৈব গ্যাসগুলির কথা জানা গেছে, সেটাই সৃষ্টি করা সম্ভব হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এই প্রথম গবেষনাগারে কোন গ্রহ বা উপগ্রহের আবহমন্ডলকে হুবহু তৈরি করা সম্ভব হয়েছে।
এদিকে গবেষণাগারে সেই পরীক্ষা পাত্রের মধ্যেকার কঠিন পদার্থটি নিয়ে তার অপটিক্যাল প্রপার্টি পরিমাপ করে দেখা হয়। তারপর ভয়েজার থেকে পাওয়া টাইটানের মেঘ সম্পর্কিত তথ্যকে গবেষণাগারে পাওয়া তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা গেছে, এদের মধ্যে সুন্দর সাদৃশ্য রয়েছে।
নারলিকার : কি ধরনের তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের বিস্তৃতি আপনি পরিমাপ করেছেন?
সাগান : আমরা এখন পর্যন্ত সফট্ এক্সরে থেকে মাইক্রোওয়েভ পর্যন্ত, পর্যবেক্ষণজাত ধ্রুবকগুলিকে পরিমাপ করেছি। তবে টাইটারকে ঐ পর্যায়ে মাপা হয়নি। অবশ্য এর দৃশ্যমান, অতিবেগুনি ও অবলোহিত রশ্মির কাছাকাছি রশ্মিগুলিকে মাপা হয়েছে। গবেষণাগারে পাওয়া তথ্যের সঙ্গে এর সুন্দর সাদৃশ্য আমরা লক্ষ্য করেছি।
সুতরাং এখন প্রশ্ন হওয়া উচিত : কি সেই কঠিন পদার্থ? লবনের গুড়োই বা কি দিয়ে তৈরি? আমরা অবশ্য এই লবনের গুড়োতে এক ফোঁটা জল ফেলে পেয়েছি নানা ধরনের অ্যামিনো এসিড। সেটি পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এতে রয়েছে নানা ধরনের জৈব অনু। কিছু প্রাণের সৃষ্টি হয়েছে যে ধরনের জৈব অনু দিয়ে তার মতো কিছু ভিন্ন গোত্রের। সুতরাং আমরা রীতিমত উত্তেজিত এটা জেনে যে প্রাণ সৃষ্টির মুহুর্তে পৃথিবীতে যে অবস্থা বিরাজ করেছিল, টাইটানের বুকেও অনুরূপ অবস্থা বিরাজ করার সম্ভাবনা খুবই প্রবল।
অবশ্য এই দুইয়ের মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। প্রথমত টাইটানে প্রবল ঠান্ডা বিরাজ করছে। সুতরাং ঐ তাপমাত্রায় তরল জলের দেখা পাওয়ার কথা নয়। তবে বিভিন্ন গ্রহের প্রভাবে যে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ঘটে, তাতে মাঝে মাঝে তরল জলের দেখা যে পাওয়া যায় না,তা নয়। টাইটানেরও প্রায় সর্বত্র তরল জলের দেখা পাওয়া গেছে। সুতরাং এটাকেই আমরা ইঙ্গিতবহ সাফল্য হিসাবে মনে করছি।
প্রকৃতপক্ষে গ্রহ-উপগ্রহের আবহমন্ডলে সংগঠিত রাসায়নিক অবস্থাকে এই প্রথম গবেষণাগারে সঠিকভাবে তৈরি করতে সফল হওয়ায় আমাদের মধ্যে আস্থার সৃষ্টি হয়েছে যে, অন্য গ্রহের আবহমন্ডলের অনুরূপ আবহাওয়া কিংবা পৃথিবীতে জীবন সৃষ্টির লগ্নে অবস্থা কেমন ছিল তা গবেষণাগারে যখন তৈরি করতে চেয়েছি তা প্রকৃত অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া স্বাভাবিক।
নারলিকার : সৌরজগতের অন্য কোথাও কি আপনি প্রাণের উপস্থিতি অনুমান করেন?
সাগান : প্রাণ সম্পর্কে আমরা কোন কথাই বলিনি। আমরা শুধু বলেছি, জৈব রসায়নের কথা। আমাদের কাছে প্রথম প্রশ্নই করা দরকার, টাইটানের বুকে কি প্রাণের উপসি’তি রয়েছে? এর উত্তরে আমি অনায়াসেই বলতে পারি, জানি না। তাই বলে সেখানকার জটিল জৈব রাসায়নিক অবস্থার প্রেক্ষিতে প্রাণের সম্ভাবনার বিষয়টিকে পুরোপুরি বাদ দেওয়া মোটেই উচিত নয়। কিন্তু আমি যে বিষয়ে জোর দিতে চাই তা হল, দু’টি কথার মধ্যে বিস-র ফারাক রয়েছে। আমি প্রাণের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিতে চাই না মানেই সেখানে প্রাণের উপসি’তি রয়েছে তা কিন’ মোটেই নয়। সৌরজগতের কোথাও প্রাণের কোনরকম অসস্তত্বেরই প্রমান এখন পর্যন্ত পাওয়া যায় নি। বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস ও নেপচুনের মত বড় গ্রহগুলির আবহমন্ডলে তো কার্বন সমৃদ্ধ জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটেই চলছে। তবে টাইটানের আবহমন্ডলের অনুরূপ অবস্থা তৈরির সাফল্যকে একমাত্র সম্বল করে আমরা অন্য গ্রহের আবহমন্ডলের অনুরূপ অবস্থা গবেষণাগারে সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছি। এমনকি, নেপচুনের সবচেয়ে বড় চাঁদ বা উপগ্রহ ‘টাইটান’ সম্পর্কে ১৯৮৯ সালে ভয়েজার-২ মহাকাশযানের পরিভ্রমনের আগে কিছুই জানা ছিল না। সেখানকার আবহমন্ডল নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে জানা গেছে, টাইটানের আবহমন্ডল খুবই পাতলা ধরনের। তার তুলনায় পৃথিবীর আবহমন্ডল লক্ষগুণ বেশি ঘন।
সুতরাং পাতলা আবহাওয়া মানে সব কিছু প্রায় শূণ্য। ফলে সেখানে যা কিছু জৈব পদার্থ তৈরি হচ্ছে তা সঙ্গে সঙ্গে টাইটানের পৃষ্ঠদেশে জমা হচ্ছে। আর সেখানকার জৈব রাসায়নিক অবস্থা সম্পূর্ণ অন্য ধরনের - সবই বরফ পর্যায়ে - নাইট্রোজেন, মিথেন সবই জমাট অবস্থায় রয়েছে।
টাইটানের বুকে একটা সুন্দর জিনিস দেখা গেছে। টাইটানের বুকে জমা হওয়া কালো পদার্থ তুবড়ির মতো আকাশের দিকে ছিটকে বেরিয়ে যাচ্ছে এবং সামান্য চাপে সেখানকার হাওয়ায় সেগুলি উড়ে যাচ্ছে। এই ঘটনার ফলে টাইটানের বুকে দেখতে পাওয়া যায় দারুণ সুন্দর ডোরা ডোরা দাগ। এদিকে গত পাঁচ-ছয় বছরে আমরা আবিস্কার করেছি যে, ধূমকেতুতে বেশ ভালোরকম জৈব পদার্থ রয়েছে এবং এর প্রায় ২০-২৫ শতাংশই জৈব অনু।
সুতরাং প্রশ্ন হল, প্রাণ সৃষ্টিতে কি ধূমকেতুর উল্লেখযোগ্য কোন অবদান রয়েছে? এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, নানা সময়ে ধূমকেতু এসে আছড়ে পড়েছে পৃথিবীর বুকে। আর আজকের তুলনায় কয়েক হাজার বছর আগে ধূমকেতুর পৃথিবীর আছড়ে পড়ার ঘটনা ঘটেছে অনেক বেশি।
নারলিকার : আপনি কি প্রাণ সৃষ্টিতে সূচনার কথা বলছেন?
সাগান : ঠিক তাই। আমি যখন প্রাণ সৃষ্টিতে অবদানের কথা বলছি তখন বুঝতে হবে প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে যে ধরনের জৈব অনু থেকে তার কথা বলছি। জীবন- জীবকোষের কথা মোটেই বলছি না। ২০ শতাংশ জৈব পদার্থ সম্পন্ন বহু সংখ্যক ধূমকেতু পৃথিবীতে আছড়ে পড়েছে। স্বাভাবিকভাবেই পৃথিবীর বুকে সঞ্চিত হয়েছে, বেশ ভালো পরিমান জৈব পদার্থ। অবশ্য ধূমকেতু যেহেতু অসম্ভব দ্রুতগতিতে ছুটে আসে, তাই আমরা হিসেব করে দেখেছি যে, জৈব পদার্থসমূহ সবই পৃথিবীর আবহমন্ডলে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে উচ্চ তাপমাত্রায় শুকিয়ে যায়।
কিন্তু পুরানো দিনের আবহাওয়ায় আজকের তুলনায় ১০ শতাংশ বেশি চাপ ছিল বলে যদি ধরে নেওয়া যায়, তাহলে আবার কম্পিউটার মডেলে সেই অবস্থা পুনঃস্থাপন করে এক অদ্ভূত মজার জিনিস দেখতে পেয়েছি। এইক্ষেত্রে ধূমকেতুগুলির পেছনে দেখা গেছে এক ধরনের ছিপির মত জিনিস। যেগুলি বেশি উত্তপ্ত হয়না। সুতরাং সামনের এবং ভিতরের দিকের জৈব পদার্থ উচ্চতাপে শুকিয়ে গেলেও, দেখা গেছে, পেছনে ছিপির মত জিনিস থাকায় সেখানে জৈব পদার্থ সংরক্ষিত হয়। সুতরাং এইভাবে মহাজাগতিক জৈব পদার্থ পৃথিবীতে জীবন সৃষ্টিতে কোন না কোন ভাবে ভূমিকা নিয়ে থাকতে পারে।
আরেকভাবেও ধূমকেতুর জৈব পদার্থ পৃথিবীতে অবিকৃত অবস্থায় এসে থাকতে পারে। ধূমকেতুর সূক্ষ্ম ভগ্নাবশেষ পৃথিবীর আবহমন্ডলে আসছে অনেক বেশি বেশি পরিমানে। এবং সেগুলি যেহেতু পড়ছে অপেক্ষাকৃত ধীর গতিতে, তাই সেগুলি শুকিয়ে যাবার বা পুড়ে যাবার সম্ভাবনা নেই। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হিসাবে ধরা যেতে পারে ধূমকেতুর পৃথিবীতে আছড়ে পড়ার ফলে যে প্রতিঘাত তরঙ্গের সৃষ্টি হয়েছে তা পুরানো দিনের আবহাওয়ায় যদি কার্বন সমৃদ্ধ থেকে থাকে, তাতে কোন বিক্রিয়া ঘটলেও ঘটে থাকতে পারে।
আসলে আমরা এখন পর্যন্ত বাইরে থেকে এবং ভিতর থেকে যতভাবে জৈব পদার্থের উৎস খুঁজে পাওয়া সম্ভব তার একটা সুসংহত তালিকা তৈরি করেছি। ভিতর থেকে বলতে আমি বোঝাতে চেয়েছি, বজ্রপাতের ফলে সৃষ্ট বৈদ্যুতিক ক্রিয়া বা সূর্য থেকে আসা অতিবেগুনি রশ্মি - কোন উৎস কি ধরনের ভূমিকা পালন করেছে।
তবে সিদ্ধান্ত অবশ্যই মডেল নির্ভর। যদি আগেকার আবহমন্ডল হাইড্রোজেন সমৃদ্ধ ছিল বলে ধরা হয়, তাহলে অনেক জৈব পদার্থের সৃষ্টি সম্ভব। কিন্তু তা না হয়ে যদি ভূবিজ্ঞানীদের অনুমান অনুযায়ী ধরা হয়, আবহমন্ডল প্রধানত কার্বন-ডাই-অক্সাইড সমৃদ্ধ ছিল তাহলে জীবনের উৎস সন্ধান খুব সহজ কাজ নয়। তবে, সেইক্ষেত্রে কি ঘটেছিল সেটা জানা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি।
এই হল মোটামুটি জীবনের উৎস সন্ধানে মহাজাগতিক জৈব পদার্থের কতটা যোগ থাকতে পারে তা নিয়ে গবেষণার কথা।
নারলিকার : মহাকাশে বুদ্ধিমান জীবের সন্ধানে কর্মসূচি (SETI - Search Extraterritorial Intelligence) বিষয়ে আপনার লেখা ‘দি কসমিক কানেকশন’ বইটি আমার আগ্রহকে বাড়িয়ে দিয়েছে। আমেরিকায় এখন সেই অনুসন্ধানের কাজ কোন পর্যায়ে?
সাগান : আশ্চর্যজনকভাবে ভাল অবস্থায় রয়েছে। আশ্চর্যজনকভাবে ভাল বলছি এই কারণে যে, ভিনগ্রহে জীবের সন্ধান নিয়ে মজা বা বিদ্রুপ করা খুবই সোজা। প্রশ্ন উঠতেই পারে, আমাদের যেখানে হাজারো জরুরী সামাজিক সমস্যা রয়েছে সেখানে ভিন গ্রহের ছোট্ সবুজ মানুষের খোঁজ করতে জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ ব্যয় করা কি উচিত? এ কেমন অর্থের অপচয়! আপনি কি এসব ভেবেছেন কখনো?
আমার মতে বিজ্ঞানীরা যদি এই ধরনের প্রকল্পের সদুত্তর দিতে না পারেন, তাহলে তাদের জনগণের অর্থ নেয়া উচিত নয়। আসলে এইসব প্রশ্ন খুবই যুক্তিসঙ্গত।
এই মুহুর্তে আধুনিকতম এক অনুসন্ধান কর্মসূচি নিয়ে কাজ চলছে। এর নাম দেওয়া হয়েছে মেটা (META - Mega channel Extraterritorial Array)। উত্তর গোলার্ধে ম্যাসচুসেটস্ এর কেমব্রিজে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস্ আয়ারস এর ঠিক বাইরে একসঙ্গে লক্ষ লক্ষ আলাদা আলাদা বেতার তরঙ্গের উপর নজর রাখা হচ্ছে। আর এই কাজ চলছে কোন সরকারি অর্থে নয়। সম্পূর্ণভাবে বেসরকারি একটি সংস্থার সদস্যদের অর্থে পরিচালিত হচ্ছে এই কর্মসূচিটি। সংস্থার নাম দেওয়া হয়েছে ‘দ্য প্ল্যানেটরি সোসাইটি’। আর আমিই এর সভাপতি। এই কর্মসূচির জন্য শুধু আমেরিকা নয় গোটা বিশ্ব থেকে পাঁচ, দশ ও পনের ডলার দান হিসাবে নিয়ে গঠন করা হয়েছে অর্থ ভান্ডার। ঐ থেকেই নিশ্চয় বোঝা যাচ্ছে যে, এখনও ভিনগ্রহে বুদ্ধিমান জীবের খোঁজে আগ্রহ কত ব্যাপক এবং দ্বিতীয়ত এজন্য খরচ হচ্ছে কত সামান্য।
এই বছর নাসা (NASA - National Aeronautics and Space Administration) আরও আধুনিকতম এক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এখনও এর যুতসই কোন নাম দেয়া হয়নি। তবে আমি মনে করি আগামী ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে আমরা যদি ভিনগ্রহের অনুমিত সভ্যতা থেকে যদি কোন বেতার সংকেত না পাই, তাহলেও বুঝতে হবে যে, আমরা গুরুত্বপূর্ণ একটা কিছু জানলাম।
নারলিকার : এই ধরনের গবেষণায় বিভিন্ন তত্ত্ব ও অনুমানের ক্ষেত্রে কোন সীমা নির্ধারণ করা কি উচিত?
সাগান : সেটা অবশ্য ঠিক কথা। তবে আমরা যদি সফল হই, তাহলে তো সেটা হবে বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বৈপ্লবিক আবিষ্কার।
নারলিকার : এই সূত্রে আমি জানতে চাই যে, ভারতেও আমরা একটা বিশাল বেতার দূরবীন বসানোর কাজ চালাচ্ছি। পুনে থেকে ৯৫ কিলোমিটার দূরে এটি বসানো হচ্ছে। এটির কাঠামোটি হবে Y আকৃতির। এর প্রতিটি লম্বা রেখায় ছ’টি করে অ্যান্টেনা বা গ্রাহক যন্ত্র থাকবে। প্রতিটি রেখা হবে কয়েক কিলোমিটার দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। আর প্রতিটি ডিস অ্যান্টেনার ব্যাস হবে ৪৫ মিটার। এই প্রকল্পটিতে আমি আমার সহকর্মী ড. গোবিন্দ স্বরূপের সঙ্গে কাজ করছি। তিনিই অবশ্য এর প্রধান মাথা। আপনাদের SETI কর্মসূচির জন্যও এটিকে ব্যবহার করতে পারবেন। আমার মনে হয় এই দারুন যন্ত্রটিকে মহাজাগতিক সংকেত ধরার কাজে আংশিক সময়ের জন্য ব্যবহার করা যাবে।
সাগান : ভিন গ্রহের কোন সভ্যতা থেকে আসতে পারে এমন কোন সংকেত অনুসন্ধানের কাজে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছাড়া মোটেই সম্ভব নয়। ভিনগ্রহ থেকে যদি সত্যিই কোন সভ্যতা সংকেত পাঠিয়ে থাকে তবে তা তো আর বিশেষ কোন দেশকে লক্ষ্য করে পাঠাবে না।
নারলিকার : সেটাই তো আসল কথা। আর জানা কোন বিশেষ ভাষাতেও নিশ্চয়ই পাঠাবে না।
সাগান : আমরা আপনাদের প্রকল্পের জন্য কোনভাবে সাহায্য করতে পারি কিনা তা জানাবেন। আমাদের সম্পদ যদিও সীমিত, তবুও আমরা কিভাবে কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে কিংবা কোন ধরনের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হচ্ছে সে ব্যাপারে নিশ্চয়ই প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা করতে পারি।
নারলিকার : নিশ্চিতভাবেই এটাও আমাদের কাছে বিশেষ কাজের হবে আমাদের কর্মসূচিটি (GMRT) যেহেতু ১৯৯৪ সাল নাগাদ শুরু হবে সুতরাং হাতে দু’বছর সময়ও রয়েছে।
আমি এখন অন্য বিষয় যেতে চাই। আপনি তো নানাভাবে বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার কাজ করে চলেছেন। ভারতে তো ‘কসমস’ টিভি সিরিয়ালটি খুবই জনপ্রিয় হয়েছে। আমি বহু তরুণ ছাত্র/ছাত্রীদের কাছ থেকে এ ব্যাপারে নানা ধরনের প্রশ্ন পেয়েছি। নিঃসন্দেহে এই প্রোগ্রামটি জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে সচেতনতা যথেষ্ট বৃদ্ধি করেছে। বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি?
সাগান : আমরা সমপ্রতি কসমস সিরিয়ালটিও প্রাপ্ত নতুন তথ্যেও আলোকে নতুন করে সাজিয়েছি। যখন এটি প্রথম তৈরি করেছিলাম, তখন শনি, ইউরেনাস, নেপচুন বা হ্যালির ধূমকেতুর মতো কোন ধূমকেতুর কাছাকাছি মহাকাশযান যেতে পারেনি। এখন অনেক তথ্য জানা গেছে, শনি, ইউরেনাস, নেপচুনের বলয় ও চাঁদ সম্পর্কে। এইসব তথ্য যুক্ত করতে হয়েছে কসমস সিরিয়ালে। কসমস এর এই নতুন সংস্করণটি ভারতে যাতে দেখানো যায় সেজন্য কথাবার্তা চলছে। যদিও আমি এখনও এ ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত নই, তবে আশা করি শেষ পর্যন- এটি দেখানো যাবে।
মূল কসমস ধারাবাহিকটি তৈরি করতে প্রায় আড়াই বছর সময় লেগেছিল। আর শুধুমাত্র এই কাজেই লেগে থাকতে হয়েছিল। কিন্তু আমার পক্ষে এই ধরনের কাজ আর নতুন করে করা সম্ভব নয়। তবে বিজ্ঞানের বিভিন্ন দিককে জনপ্রিয় করার জন্য আমি লিখে চলেছি। আমার সর্বশেষ বইটি আমার স্ত্রী অ্যান্ড্রুয়ানের সঙ্গে যৌথভাবে লিখেছি। নাম দিয়েছি ‘বিস্মৃত পূর্বসূরীদের ছায়া’। এই বইয়ে দেখানো হয়েছে, মানুষ কেন আজকের অবস্থায় এসেছে? কোথা থেকেই বা নিজেকে উন্নততর ভাবা, অন্য জীব সম্পর্কে ঘৃণা ও খবরদারি করার মানসিকতা এসেছে? কোথা থেকেই বা মহিলাদের উপর নির্যাতনের মানসিকতা এসেছে? ভারতীয় জীবনেও এমন ঘটনার অজস্র নিদর্শন রয়েছে। রয়েছে মার্কিনী জীবনেও। প্রত্যেকেই এই সব ঘটনার নিন্দা করেন, তবুও এগুলি টিকে রয়েছে। তাই আমরা মনে করেছি, এই ধরনের মানসিকতার সূত্রে অনুসন্ধান অনেক বেশি জরুরী ও প্রয়োজনীয়। এই বিষয়গুলি জ্যোতির্বিজ্ঞানের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত নয় ঠিকই, তবে এগুলি যে গুরুত্বপূর্ণ সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
নারলিকার : জ্যোতির্বিজ্ঞানের কোন বিষয় নিয়ে আমি যখন বক্তৃতা দেই, তখন দেখেছি শ্রোতারা সাধারণভাবে শেষেই প্রশ্ন করেন। অনেকে সরাসরি যে বিষয়ে বক্তৃতা দেই, সে বিষয়ে প্রশ্ন করেন, যেমন, মহাবিস্ফোরণ কিংবা কৃষ্ণগহ্বর সম্পর্কে। তার অনেকেই বিষয় যাই হোক না কেন উড়ন্ত চাকতি বা UFO কিংবা বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল সম্পর্কে, আমার ধারণা আপনিও নিশ্চয়ই এই ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি হন। কিন্তু এই সব প্রশ্নের উত্তর দেন কিভাবে?
সাগান : হ্যাঁ। এখানেই আমি একজনের ফোন পেয়েছি, যিনি আমাকে তাঁর সংগ্রহে নাকি উড়ন্ত চাকতির নিদর্শন রয়েছে, সেটি দেখাতে চান।
আমি এই ধরনের তাৎক্ষণিক উত্তর দিতে অভ্যস-। বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল বলতে দাবি করা হয়, বারমুডা দ্বীপের কাছে আটলান্টিক মহাসাগরে এমন একটি জায়গা রয়েছে, যেখানে নাকি বিমান ও জাহাজ রহস্যজনকভাবে লাপাত্তা হয়ে যায়। এখন, প্রথম প্রসঙ্গিক তথ্যটি হল, জলে কোন বস’র ডুবে যাওয়া ভৌত ঘটনা বলে জানি। ধরা যাক এর সঙ্গে ট্রেনের লাপাত্তা হয়ে যাওয়া তুলনা করা যায়। যদি দেখা যায়, পুনে ট্র্যাঙ্গেলে ভারতের গাড়িগুলি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে, তাহলে বলতে হবে এটা সত্যিই রহস্যজনক ঘটনা। কেননা, ট্রেন কিন্তু নিশ্চিহ্ন হতে পারে না অথচ বিমান বা জাহাজের নিশ্চিহ্ন হওয়ার ঘটনা আমাদের জানা। এগুলি যেমন ডুবে বা ভেঙ্গে পড়ে তেমনি সাগরতলে বা মাটিতে জমাও হয়, সুতরাং এগুলির ক্ষেত্রে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া কোন রহস্য নয়।
সুতরাং বারমুডা ট্র্যাঙ্গেল সম্পর্কে আমার প্রশ্ন হল জাহাজ ও বিমান কি বারমুডা ট্র্যাঙ্গেলে পৃথিবীর অন্য জায়গা থেকে বেশি হারিয়ে যাচ্ছে? এবং এর উত্তর নিশ্চিতভাবেই - না। আসলে বারমুডা ট্র্যাঙ্গেল কোন রহস্য নয়। সবটাই অজ্ঞতা। এক অর্থে বুজরুকি। মানুষকে ভুল বুঝিয়ে বিভ্রানি- সৃষ্টি করে অর্থ উপার্জনের চেষ্টা।
আর UFO প্রসঙ্গে একটা কথা বলি। আপনি তো জানেন, ভিন গ্রহে জীব সম্পর্কে আমার চেয় বেশি কেউ আগ্রহী নিশ্চয়ই নয়। প্রাণের সঞ্চালনে গ্রহ-গ্রহান্তরে মাহাকাশযান পাঠানোর সব কর্মসূচিতেই আমি গভীরভাবে জড়িত। বহির্বিশ্ব থেকে কেউ কোন বেতার সংকেত পাঠালোকি না তার সন্ধানেও আমি যুক্ত। সুতরাং ভিনগ্রহে সভ্যতার কোন সন্ধান পেলে আমিই সবচেয়ে বেশি খুশি হব। কিন্তু অসাধারণ একটা দাবির জন্য তো অসাধারণ প্রমানের দরকার। আর UFO এর ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত পাওয়া কোন প্রমানই তেমন ভাল নয়। এমন অনেক বিষয় আছে যেগুলি সম্পর্কে সাধারণ মানুষ ভাবতে পারেন কিছূ ঘটেছে, কিন্তু তা আদৌ না-ও হতে পারে। মানুষের আচার ব্যবহারে এই মনস-াত্ত্বিক ব্যাপারটি অস্বাভাবিক কিছু নয় আর মানুষ অনেক সময় মিথ্যেও বলে। যেমনি মানুষ মদ্যপও হয়, তেমনি আকাশকুসুম কল্পনাতেও অভ্যস্ত।
এ পর্যন্ত লক্ষ লক্ষ UFO এর কথা শোনা গেছে। কিন্তু এর কোন ক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষদর্শীরা মহাবিশ্ব থেকে পাওয়া কোন বস্তু দেখাতে পেরেছেন? যেমন ধরা যাক, অদ্ভূত লিপির কোন বই রয়েছে পৃথিবীতে? অজানা এমন কোন সংকর ধাতু কিংবা এমন কোন পদার্থ, যার অভিকর্ষ বিরোধী ধর্ম রয়েছে? তাছাড়া যা দেখা যায় তাই কি বাস্তব? উত্তর অবশ্যই, না একটি ভাল ছবিও জাল হতে পারে। অনেক ঘটনাই নির্ভরযোগ্যভাবে প্রকাশ করা হতে পারে - যেমন শ’য়ে শ’য়ে শত্রুর বিভিন্ন জায়গা থেকে আকাশে আলোক রশ্মি দেখতে পেলেন। কিন’ আকাশে তো বহু কিছুর জন্যই আলো দেখা যেতে পারে। কক্ষপথে স’াপিত হওয়ার আগ মুহুর্তে রাশিয়ার বা আমেরিকার কোন বুস্টার থেকেও মোহময় আলোর দ্যুতি দেখা যেতে পারে। সুতরাং আবারও আমি বলতে চাই, অসাধারণ কোন কোন দাবির জন্য তেমনই অসাধারণ কোন প্রমান হাতে থাকা চাই। আর শুধু প্রমানই যথেষ্ট নয়। হাতে যদি সত্যিই ভালো প্রমান থাকে তো সে ব্যাপারে আমি খুবই খোলামেলা। তবে, আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছি যে, একজন বা দু’জন মানুষের কাছ থেকে তাদের দাবি মত অসাধারণ অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে যাওয়াটা আসলে সময়ের অপচয় মাত্র। এদের অনেকেই হয়তো আন্তরিক, কিন্তু তাদের কোন দাবিই বৈজ্ঞানিক প্রমানে প্রয়োজনীয় মানের ধারে কাছে নয়। তাই যারা মহাকাশে যান তাদের প্রত্যেককেই আমি বলি, দয়া করে আসবার সময় সঙ্গে করে নিয়ে আসবেন মহাজাগতিক কোন জীবকে।
নারলিকার : আথবা কোন মহাজাগতিক বস্তু ………।
সাগান : মহাজাগতিক জীবই সবচেয়ে ভাল। তবে কোন বস্তু, নিদর্শন বা যে কোন ধরনের পোষ্য কিছু হলেও ভাল।
নারলিকার : ধরা যাক, আপনি ভিনগ্রহে কোন বুদ্ধিমান জীবের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারলেন, তখন আপনি তাদের কি প্রশ্ন করবেন? আর এটাতো নিশ্চয়ই ধরে নেবেন যে, তারা আমাদের থেকে অনেক বেশি জ্ঞানী হবে।
সাগান : তাদের সঙ্গে যোগাযোগটাই হবে আসল ব্যাপার। তবে আমার মনে হয়, পদার্থবিজ্ঞান, অংক কিংবা জৈব বিজ্ঞান সংক্রান্ত প্রশ্নে চেয়ে অনেক বেশি জরুরি সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় বিষয়ে প্রশ্নও আকর্ষণীয় হতে পারে। হয়তো জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে, ফরম্যাটের শেষ উপপাদ্যগুলি ঘনককে দু’টি ঘনকে পরিণত করা সম্ভব অথবা একটি চতুর্থ ঘাতকে দু’টি চতুর্থ ঘাতে অথবা যেকোন ঘাতকে (সসীম বা অসীম) দু’টি সম ঘাতসম্পন্ন রাশিতে পরিণত করা সম্ভব। এই উপপাদ্যটির প্রমান এখনও পাওয়া যায়নি।
নারলিকার : এ ব্যাপারে আমার প্রশ্ন হতে পারে: রেম্যান প্রকল্প কি সঠিক? (এই প্রকল্পটিও প্রমাণ করা যায়নি। জটিল রাশির আপেক্ষিতা সম্পর্কিত রেম্যান প্রকল্পের মৌলিক রাশির সংঘাতের প্রত্যক্ষ প্রয়োগ রয়েছে)
সাগান : হ্যাঁ, এই ধরনের প্রশ্ন এবং এর চেয়েও কঠিন কঠিন বিষয়ে প্রশ্ন করা যেতে পারে।
নারলিকার : আমি অংক বা পদার্থবিজ্ঞানকে বাছাই করার পক্ষপাতী, কারণ, উভয়ের ক্ষেত্রে সমস্যা হবে একটা। আর সামাজিক সমস্যা বা অর্থনৈতিক সমস্যা .. .. ..
সাগান : ঠিক তাই। কে জানে তারা কেমন দেখতে? কেমনই বা তাদের সমস্যা? যাই হোক, কোনটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সেটা ঠিক করাই আমার পক্ষে কঠিন। তবে আমি সেই দিনের দিকে তাকিয়ে রয়েছি। খুব মজা হবে সে সময়।
নারলিকার : আপনি তো পারমাণবিক বিপর্যয়, পারমাণবিক শৈত্য এবং এই ধরনের বিষয়ে অনেক লেখাই লিখেছেন। কিন্তু অবস্থার কি কোন পরিবর্তন দেখছেন?
সাগান : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ওসাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে উত্তেজনা যে অনেকটাই প্রশমিত হয়েছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। দুই দেশের এই অবদানের জন্য সকলেই কৃতজ্ঞ। তবে, আমার বিচারে প্রধান অবদান মিখাইল গর্বাচেভের। ইতিহাসের দিকে বস্তুগতভাবে যদি দৃষ্টি ফেরাই তাহলে দেখি গর্বাচেভ এমন এক ব্যক্তিত্ব, যার কোন কিছু করার মত দৃঢ়তা ও বলিষ্ঠতা ছিল। ওয়ারশ’ জোট আজবেঙ্গে গেছে। পাঁচ-ছয় বছর আগেও এটা কি কেউ ভাবতে পেরেছিল? নিঃসন্দেহে চমকপ্রদ ঘটনা। অবশ্য কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি সোভিয়েত ইউনিয়ন, কোন দেশই একটিও পরমানু অস্ত্র ধ্বংস করেনি। অনুামানিক প্রায় ৫৫ হাজার পরমানু অস্ত্র তো যে কোন মুহুর্তে প্রয়োগ করার জন্য তৈরি রাখা হয়েছে। সুতরাং এই অবস্থাকে মোটেই নিরাপদ বলা যায় না। তবে, পুরোপুরি নিরাপদ না হলেও নিরাপত্তার আভাস মিলেছে।
নারলিকার : তাছাড়া তথ্য পাচার ও ছোট ছোট দেশ বা গোষ্ঠীর হাতে পরমানু অস্ত্র আসার ফলে বিপদ বাড়ছে।
সাগান : আমি শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের কথা বলছি। এ ক্ষেত্রেও বড় রকমের বিপদের ঝুকি রয়েছে। যেমন সোভিয়েত ইউনিয়নে পরমানু অস্ত্র ভান্ডারের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে সেটা একটা বড় ব্যাপার। মনে রাখা দরকার, তাদের হাতে ২৫ হাজার পরমানু অস্ত্র রয়েছে। এবং এর শ’ খানেকেই কোন দেশকে ধ্বংস করা কিংবা কোন শহরকে লক্ষ্য করে পারমাণবিক শৈত্য সৃষ্টি করার পক্ষে যথেষ্ট।
আর অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে তো উদ্বেগজনক। আর আমি বলি কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, বৃটেন, ফ্রান্স, চীন ও ইস্রায়েলের হাতে পরমানু অস্ত্র থাকা খুবই বিপজ্জনক। যদি মেনে নেওয়ায় যায় যে ঐ সবদেশের সামরিক ও রাজনৈতিক নেতারা সম্পূর্ণভাবে স্বাভাবিক ও নমনীয় এবং গোটা পরিসি’তি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, কিন্তু এটা যে সব সময় বজায় থাকবে তার কি নিশ্চয়তা আছে? আর এখন অনেক দেশেরই পরমাণু অস্ত্র থাকার ফলে উম্মাদ নেতাদের নিয়ন্ত্রণে তা আমাদের বিপদও বাড়িয়ে দিয়েছে। এই শতাব্দীতেই আমরা হিটলার ও স্টালিনের মত উম্মাদ নেতাদের পেয়েছি। পরমাণু অস্ত্র সম্পর্কে সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হল, এটা যার হাতে থাকবে তাকে কোনঠাসা করতে পারবে না।
পরমাণূ অস্ত্রকে যদি বেশি গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করা হয় তাহলে সেটা খুবই বিপজ্জনক। সুতরাং আমার মনে হয়, বিভিন্ন দেমের উচিত তাদের হাতে পরমাণু অস্ত্র রাখা ঠিক, কি টিক নয়, তা গভীরভাবে বিবেচনা করা। আর এ ব্যাপারে প্রাথমিকভাবে দায়িত্ব কাঁধে নিতে হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং পশ্চিম ইউরোপকে।
নারলিকার : জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে আমরা আলোচনা শুরু করেছিলাম। সুতরাং শেষও করতে চাই ঐ বিষয় নিয়েই। ভারতে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতিঃর্পদার্থ বিজ্ঞান বিশেষ গুরুত্ব পেতে চলেছে। দেশজুড়ে এ ব্যাপারে আমরা বিশেষ সুবিধা দেবার উদ্যোগ নিয়েছি। বিভিন্ন জায়গায় বেতার দূরবীক্ষণ যন্ত্র বসানো হচ্ছে, তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন কেন্দ্র সুতরাং আবার আপনি ভারতে আসবেন এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান কেন্দ্রগুলি পরিদর্শন করবেন এই আশা পোষণ করছি।
সাগান : ধন্যবাদ, ড. নারলিকার। আপনারা যেভাবে কাজ করে চলেছেন তাকে প্রশংসা করছি। আর জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণার উন্নতি ঘটানোই নয়, ভারতে জ্যোতির্বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার কাজটিও আপনারা ভালভাবেই করেছেন।
নারলিকার : আপনার এই সফর আমাদের বিশেষ প্রেরণা যুগিয়েছে।
সাগান : ধন্যবাদ। আমি আপনাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।
সূত্র: জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকারের ’মহাবিশ্বে মহাকাশে’ বই থেকে সংকলিত।