শনিবার ● ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১১
প্রথম পাতা » আবার পড়ুন » বানর থেকে মানুষের বিবর্তনে শ্রমের ভূমিকা - ফ্রেডরিক এঙ্গেলস
বানর থেকে মানুষের বিবর্তনে শ্রমের ভূমিকা - ফ্রেডরিক এঙ্গেলস
সমস্ত সম্পদের উৎস হলো শ্রম - অর্থতত্ত্ববিদরা এই কথাই বলেন। যে প্রকৃতির কাছ থেকে পাওয়া উপাদানকে শ্রম রূপান্তরিত করে সম্পদে, সেই প্রকৃতির পরেই শ্রমের স্থান। কিন্তু শুধু এই নয়, এর চাইতেও তার গুরুত্ব অপরিসীমভাবেই বেশি। সমস্ত মানবিক জীবনের প্রাথমিক মূলগত শর্ত হলো শ্রম এবং তা একদিক থেকে বলতে হবে যে, একটা পরিমাণে স্বয়ং মানুষই হলো শ্রমের সৃষ্টি।
লক্ষ লক্ষ বছর আগে পৃথিবীর ইতিহাসে এমন একটি যুগ ছিল ভূতাত্ত্বিকরা যাকে অভিহিত করেন তৃতীয় ভূ-স্তর যুগ (টারশিয়ারী যুগ) বলে। সেই যুগের এক সময়, যা এখন পর্যন্ত সঠিকভাবে নির্ণীত হয়নি, খুব সম্ভবত সেই যুগের শেষের দিকে গ্রীষ্ম মন্ডলের কোথাও - হয়তো বা বর্তমানে ভারত মহাসাগরের গর্ভে নিমজ্জিত এক বিশাল মহাদেশ - বিশেষভাবে উন্নত কিছুটা মনুষ্যাকৃতির এক বানর জাতির বাস ছিল। আমাদের এই পূর্বপুরুষদের একটা মোটামুটি বিবরণ দিয়েছেন ডারউইন। তারা বাস করত গাছে গাছে দল বেঁধে।
অনুমান করা যায়, তাদের যে জীবন ধারায় গাছে ওঠানামার ব্যাপারে হাতের কাজ ছিল পা থেকে ভিন্ন, তারই প্রত্যক্ষ পরিণাম হিসাবে ভূমির উপর দিয়ে হাঁটাচলার সময় তারা হাতের সাহায্য নেবার অভ্যাস থেকে ক্রমে ক্রমে নিজেদের মুক্ত করতে এবং সোজা হয়ে দাঁড়াবার ভঙ্গি আয়ত্ত করতে শুরু করল। বানর থেকে মানুষের উত্তরণে এই হলো চূড়ান্ত পদক্ষেপ।
বর্তমানের সমস্ত মনুষ্যাকৃতি বানরই দুপায়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে এবং চলাফেরা করতে পারে, কিন্তু তা কেবল জরুরী প্রয়োজনের সময় আর নেহাতই আনাড়ির মতো। তাদের স্বাভাবিক চলাফেরা হলো আধা-সোজা হয়ে দাঁড়াবার ভঙ্গিতে, হাতও সেজন্য কাজে লাগে। তাদের অধিকাংশ পা-দুটি গুটিয়ে, মাটিতে হাতের মুঠোয় গিঁটে ভর দিয়ে, দীর্ঘ বাহুর সহায়তায় শরীরটাকে এগিয়ে দেয় - ক্রাচের সাহায্যে মানুষ যেমন চলাফেরা করে, অনেকটাই সেই রকম। চার-পা থেকে দু-পায়ে চলা পর্যন্ত উত্তরণের প্রতিটি পর্যায়েই আজও আমরা সাধারণভাবে বানরদের মধ্যে লক্ষ্য করতে পারি। কিন্তু এদের কারুর কাছেই দু-পায়ে চলাফেরার রীতিটা একটা দায়সারা ব্যাপার ছাড়া বেশি কিছু নয়।
আমাদের লোমশ পূর্বপুরুষদের মধ্যে ঋজু দেহগুলি যে প্রথমে প্রচলিত এবং কালক্রমে একটি প্রয়োজন হয়ে দেখা দিল, তাতে ধরে নিতে হয় যে ইতিমধ্যেই নানা বিচিত্র কাজের ভার ক্রমেই বেশি করে হাতের উপর এসে পড়েছিল। এমন কি বানরদের মধ্যেও হাত ও পায়ের ব্যবহারে কিছুটা পার্থক্য দেখা যায়। আগেই বলা হয়েছে গাছে ওঠানামার ব্যাপারে হাতের কাজ পায়ের কাজ থেকে পৃথক। কিন্তু নিম্মতর স্তন্যপায়ীদের মধ্যে সামনের থাবা যে কাজ করে থাকে, বানরের হাতও মুখ্যত খাবার জোগাড় ও আঁকড়ে ধরার সেই একই কাজ করে। অনেক বানর আবার গাছে গাছে হাতের সাহায্যে নিজেদের জন্য বাসা তৈরি করে। এমনকি আবহাওয়া থেকে রক্ষা পাবার জন্য ডালের ফাঁকে ফাঁকে শিম্পাঞ্জীদের মতো ছাউনীও নির্মাণ করে। শত্রুর বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার জন্য তারা হাত দিয়ে লাঠি ধরে অথবা ফল আর পাথর নিক্ষেপ করে তার বিরুদ্ধে। বন্দীদশায় মানুষের অনুকরণলব্ধ কতকগুলি সহজ কাজও তারা হাতের সাহায্যে করে থাকে। কিন্তু ঠিক এখানেই লক্ষ্য করা যায় যে, বানরদের মধ্যে এমনকি যারা সর্বাধিক মনুষ্যাকৃতিবিশিষ্ট, তাদেরও অপরিণত হাত, আর শত সহস্র বছর যাবৎ শ্রমের ফলে সবিশেষ উন্নত মানুষের হাতের মধ্যে ব্যবধান কত বিরাট। উভয়ের অস্থি ও পেশীর পরিমাণ ও বিন্যাস একই রকম। তবুও নিম্মতর স্তরের বন্য মানুষদের হাত এমন শত শত কাজ করতে পারে যা কোনো বানরের হাতের পক্ষে অনুকরণ করা সাধ্যাতীত। এমন কি পাথরের তৈরি স্থুলতম একখানা ছুরিও বানরের হাতে গড়া সম্ভব হয়নি।
তাই বানর থেকে মানুষের উত্তরণের হাজার হাজার বৎসর ধরে আমাদের পূর্বপুরুষেরা যেসব কাজকর্মে তাদের হাতকে ক্রমে ক্রমে অভ্যস্ত করে তুলছিল, গোড়ার দিকে সেগুলি নেহাতই সাদাসিধে ধরনের হওয়ার কথা। নিম্মতর স্তরের বন্য মানুষেরা, এমনকি যাদের দেহগতভাবে অবনতি এবং সঙ্গে পশুসুলভ অবস্থার অধোগতি ঘটেছে বলে অনুমান করা হয়, তারাও এই উত্তরকালীন প্রাণীদের তুলনায় ঢের বেশি উন্নত। মানুষের হাতে পাথর থেকে প্রথম ছুরিখানা তৈরি হবার আগে হয়তো এমন এক দীর্ঘ যুগ অতিক্রান্ত হয়ে গেছে, যার তুলনায় আমাদের পরিচিত ঐতিহাসিক যুগকে মনে হবে একতান্তই নগন্য। কিন্তু তারই মধ্যে চূড়ান্ত পদক্ষেপটা নেওয়া হয়ে গিয়েছিল: হাত হলো মুক্ত, তখন থেকে তা অর্জন করে যেতে পারল ক্রমেই বেশি বেশি নৈপুণ্য ও কৌশল এবং এইভাবে অর্জিত উন্নততর নমনীয়তা সঞ্চারিত হলো বংশ-পরম্পরায়, বৃদ্ধি পেল পুরুসানুক্রমে।
(চলবে..)
মূল: ফ্রেডরিক এঙ্গেলস