শনিবার ● ২১ মার্চ ২০২০
প্রথম পাতা » বিজ্ঞান সংবাদ: মহাকাশ » গ্রহাণূ (52768) 1998 OR2 আগামী ২৯ এপ্রিল পৃথিবীকে নিরাপদ দূরত্বে অতিক্রম করবে
গ্রহাণূ (52768) 1998 OR2 আগামী ২৯ এপ্রিল পৃথিবীকে নিরাপদ দূরত্বে অতিক্রম করবে
গ্রহাণূ (52768) 1998 OR2 আগামী ২৯ এপ্রিল বাংলাদেশ সময় বিকাল ৩:৫৬ মিনিটে পৃথিবীর নিকটতম দূরত্ব দিয়ে অতিক্রম করে যাবে। এসময় গ্রহাণূটি পৃথিবী থেকে ৩৯ লক্ষ মাইল (৬৩ লক্ষ কি.মি.) দূরে থাকবে, যা পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্বের ১৬ গুণের বেশি। পাথুরে গ্রহাণূটির ব্যাস আনুমানিক ১.১ থেকে ২.৫ মাইল (১.৮ থেকে ৪.১ কি.মি.)। এরকম আকারের একটি গ্রহাণূ পৃথিবীর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে পৃথিবীকে আঘাত হানলে ধ্বংসলীলা ডেকে আনাটাই স্বাভাবিক, আর এই ধরনের অনুমানকে সংবাদ হিসেবে উপস্থাপন করে কিছু অনলাইন মিডিয়াতে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। তবে এই ধরনের অনুমান অমূলক, কারণ গ্রহাণূটি (52768) 1998 OR2 সংঘর্ষ তো দূরের কথা, পৃথিবীতে কোনপ্রকার প্রভাব বিস্তার করবে না। প্রতিটি মহাজাগতিক বস্তু নির্দিষ্ট কক্ষপথ বজায় রেখে মহাকাশে পরিভ্রমন করে, আর তাদের পরিভ্রমন পথ বিজ্ঞানীরা হিসেব করে করে জানতে পারেন সেটি পৃথিবীর জন্য নিরাপদ বা হুমকীস্বরূপ কিনা। টেলিস্কোপ দিয়ে এই গ্রহাণুটিকে খুব ধীর গতির চলমান একটি নক্ষত্রের মতো দেখা যাবে।
আলোচিত এই গ্রহাণূটিকে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা ‘সম্ভাব্য বিপজ্জনক’ হিসাবে শ্রেণিভূক্ত করেছে। তবে পৃথিবীর জন্য বিপদ ডেকে আনছে বলে এই ধরনের শ্রেণিকরণ নয়, বরং গ্রহাণূটি বিপজ্জনক মাণদন্ডের আওতাভূক্ত মাত্র। নাসা’র মতে, একটি গ্রহাণূকে ‘সম্ভাব্য বিপজ্জনক’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় যদি গ্রহাণূর কক্ষপথটি পৃথিবীর কক্ষপথকে কখনও ৪৬ লক্ষ মাইল (৭৫ লক্ষ কি.মি.) বা ০.০৫ জ্যোতির্বিজ্ঞান এককের কম দূরত্বে ছেদ করে। গ্রহাণূটি প্রতি ৩ বছর ৮ মাস সময়ে ১ থেকে ৩.৭ জ্যোতির্বিজ্ঞান একক দূরত্বে থেকে সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করে। নাসা’র Near-Earth Asteroid Tracking প্রোগ্রামের জ্যোতির্বিদরা হাওয়াইয়ের হালিয়াকালা মানমন্দির থেকে ১৯৯৮ সালের ২৪ জুলাই গ্রহাণুটিকে আবিষ্কার করেন। গ্রহাণূটি আগামী ১৮ মে ২০৩১ পৃথিবী থেকে ১২০ লক্ষ মাইল দূর থেকে অতিক্রম করবে। এর পরে আবার ৩০ মে ২০৪২, ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৮ পৃথিবীর পাশ দিয়ে অতিক্রম করবে। তবে আগামী ১৬ এপ্রিল ২০৭৯ এটি পৃথিবীর মাত্র ১১ লক্ষ মাইল দূর দিয়ে অতক্রিম করবে।
গ্রহাণু মূলত পাথরের খণ্ড যা মহাকাশে নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। আমাদের সৌরজগতের বেশিরভাগ গ্রহাণুই সূর্যের চারদিকে প্রদক্ষিণরত অবস্থায় মঙ্গল ও বৃহস্পতি গ্রহের মাঝে প্রধান গ্রহাণু বেষ্টনীতে পাওয়া যায়। গ্রহাণু সৃষ্টি সম্পর্কে প্রথমত ধারণা করা হয় প্রায় ৪৬০ কোটি বছর পূর্বে আমাদের সৌরজগৎ যখন সৃষ্টি হয়েছিল তখন মঙ্গল ও বৃহস্পতি গ্রহের মধ্যবর্তী অংশে আরো একটি গ্রহ সৃষ্টি হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু সম্মিলিত গ্রহাণুপুঞ্জের স্বল্প ভরের কারণে এবং বৃহস্পতি গ্রহের অত্যন্ত শক্তিশালী মাধ্যাকর্ষণ বল গ্রহাণুগুলিকে পরস্পরের সাথে একত্রিত হতে বাধা দেওয়ায় এই অঞ্চলে নতুন কোনো গ্রহ সৃষ্টি হতে পারেনি। দ্বিতীয়ত ধারণা করা হয়, গ্রহাণুগুলো কোনো এক গ্রহের অংশবিশেষ যা কোনো এক সংঘর্ষের ফলে পুরো সৌরজগতে ছড়িয়ে পড়ে। গ্রহাণুগুলো বেষ্ঠনীতে থেকে নির্দিষ্ট উপবৃত্তাকার কক্ষপথে সূর্যকে আবর্তন করে। কখনো কখনো এগুলো গ্রহের কক্ষপথে প্রবেশ করে গ্রহের সাথে সংঘর্ষও ঘটায়। গ্রহাণুর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি অত্যন্ত কম থাকে এবং এরা আকৃতিতে গ্রহের থেকে তুলনামূলক অনেক ছোট হয়ে থাকে। এই বেষ্টনীটিতে ১১ লক্ষ থেকে ১৯ লক্ষ গ্রহাণু রয়েছে যেগুলো ১ কিলোমিটার এর অধিক ব্যাসের বলে ধারণা করা হয় এবং লক্ষ লক্ষ গ্রহাণু রয়েছে এর থেকে ছোট আকারের।
পৃথিবীকে অতিক্রম করা বেশিরভাগ গ্রহাণূই নিরাপদ দূরত্বে থাকে, ফলে পৃথিবীকে আঘাত হানতে পারে না। কিন্তু ভবিষ্যতে এরকম কোন গ্রহাণূর সংঘর্ষ হওয়ার সম্ভাবনা নাকচ করে দেওয়া যায় না। অতীতে পৃথিবীতে গ্রহাণূ আছড়ে পড়ার বেশ কয়েকটি ঘটনা রয়েছে। ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার চেলিয়াবিনস্ক শহরের বাসিন্দা ও পথচারীদের হঠাৎ করেই আকাশে ভিন্ন এক দৃশ্য চোখে পড়ে। দিনদুপুরে এক অদ্ভুতুরে অগ্নিপিণ্ড আকাশের বুক চিরে সাঁই সাঁই করে ছুটে চলছে। রাস্তায় অনেক গাড়িরই ড্যাশবোর্ডে চালু থাকা ভিডিও ক্যামেরায় ধরা পড়ে এই মহাজাগতিক ঘটনাটি। এটি ছিল একটি জ্বলন্ত উল্কাপিণ্ড। স্থানীয় সময় সকাল নয়টা কুড়ি মিনিটের দিকে চেলিয়াবিনস্ক শহরের এক স্বল্প জনবসতিপূর্ণ এলাকায় আকাশ থেকে এই জ্বলন্ত উল্কাপিণ্ড পতনের ঘটনা ঘটে। বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, প্রায় ৫৫ ফুট চওড়া এবং ৭ থেকে ১০ হাজার টন ওজনের এই উল্কাপিণ্ড যে শক্তি নিয়ে রাশিয়ার চেলিয়াবিনস্ক শহরে এসে বিস্ফোরিত হয়েছিলো তার পরিমাণ ছিল ৫ লক্ষ টন টিএনটি বিস্ফোরকের সমান বা প্রায় ত্রিশটি পারমাণবিক বোমার সমান ক্ষমতা সম্পন্ন। মহাশূণ্য থেকে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের সময় ঘর্ষণের ফলে কয়েক হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াসে উত্তপ্ত হয়ে এটি বিস্ফোরিত হয়। প্রথম বিস্ফোরণটি মাটি থেকে ২০ থেকে ৩০ কিলোমিটার ওপরে সংঘটিত হয়। বিস্ফোরণের আলোকচ্ছটায় কিছুক্ষণের জন্য যেন সূর্যের ঔজ্জ্বলতাও থমকে গিয়েছিল রাশিয়ার আকাশ ধরে ছুটে চলা গ্রহাণুর গতিপথে। সুউচ্চ ভবনগুলো যেন ঝাপটায় কেঁপে উঠেছিল, ঘটেছিল সহস্রাধিক মানুষের আহত হওয়ার ঘটনাও। তবে এই উল্কাখন্ড বা গ্রহাণুর অংশবিশেষ যদি কোন ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় পড়তো তাহলে নিমিষেই বহু প্রাণহানির ঘটনা ঘটে যেত। রাশিয়ার এই উল্কাপিণ্ডটির অনেকখানি শক্তি বায়ুতে শোষিত হওয়ায় শেষ পর্যন্ত এটি ভূপৃষ্ঠে অনেক কম আঘাত হেনেছিল।
রাতের আকাশে প্রায়ই আমরা হঠাৎ হঠাৎ জ্বলন্ত বস্তু ছুটে যেতে দেখি। এগুলো ধুমকেতু বা গ্রহাণুর অংশবিশেষ, যা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের সময় বায়ুর ঘর্ষণে জ্বলে ওঠে। এই আলোকিত বস্তুপিণ্ডই উল্কাপাত হিসেবে পরিচিত, যা বেশিরভাগ সময়ে আকারে ছোট থাকায় বায়ুমণ্ডলেই জ্বলে নিঃশ্বেষ হয়ে যায়। কিন্তু কখনো কখনো বড় আকৃতির উল্কা সম্পূর্ণরূপে পুড়ে না গিয়ে ভূপৃষ্ঠে এসে পতিত হয়, যা উল্কাপিণ্ড বলে পরিচিত।
রাশিয়ার ওই ঘটনা পেরিয়ে যদি আমরা ফিরে যাই ১৯০৮ সালে, তাহলে আমরা জানব সাম্প্রতিক পৃথিবীর অন্যতম এক ভয়াবহ মহাজাগতিক আঘাতের কথা। ১৯০৮ সালের ৩০ জুন সাইবেরিয়ার তুঙ্গাসকায় প্রায় ২,০০০ বর্গ কিলোমিটারেরও বেশি এলাকার বনভূমি মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিল এক দানবীয় উল্কাপিণ্ডের আঘাত। স্থানীয় সময় সকাল সাতটা সতেরো মিনিটে তুঙ্গাসকা অঞ্চলে গত একশো বছরের নথিভুক্ত সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণের পরিমানের চাপ ও তাপ ছিল প্রায় ১৮৫টি হিরোশিমা বোমার সমান! বিজ্ঞানীদের ধারণা এটি ছিল প্রায় ৩০০ ফুটের অধিক ব্যাসসম্পন্ন ও প্রায় ৭০ কিলোটন ভরের একটি পাথুরে উল্কাপিণ্ড।
একসময় পৃথিবী দাপিয়ে বেড়ানো ডাইনোসররা ক্রিটেশিয়াস যুগের শেষে প্রায় সাড়ে ৬ কোটি বছর পূর্বে অন্তত ১০ কিলোমিটার আকৃতির গ্রহাণুর আঘাতে সৃষ্ট পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়ে যায়। বাংলাদেশেও উল্কাপতন হয়েছে। ২০০৬ সালের ৩১ জানুয়ারি ঠাকুরগাঁয়ের সিংপাড়া গ্রামে একটি উল্কাপিণ্ডের পতন ঘটে। মাত্র ২.৫ কিলোগ্রাম ভরের এই উল্কাপিণ্ডটি সৌরমণ্ডলের আদি সময়ে সৃষ্ট কোন গ্রহাণুর টুকরো বলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন। এর পতনের ফলে মাটিতে এক মিটার গভীর গর্তের সৃষ্টি হয়।
তবে আমাদের জন্য আশার কথা হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে বিজ্ঞানীরা এই জাতীয় কোন মহাজাগতিক বিপর্যয়ের কোন সম্ভাবনা এখনো খুজেঁ পাননি। বিভ্রান্তিকর সংবাদ বিভিন্ন সময়ে মানুষের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিলেও বাস্তবে পৃথিবী ধ্বংসের মতো কোন শঙ্কার অবকাশ নেই।
সূত্র: নাসা