শনিবার ● ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১১
প্রথম পাতা » চাঁদে অভিযান » চাঁদে অবতরণ: মানব ইতিহাসে এক স্মরণীয় অধ্যায়
চাঁদে অবতরণ: মানব ইতিহাসে এক স্মরণীয় অধ্যায়
রূপকথার চাঁদে বাস করা ‘চাঁদের বুড়ী’, যিনি চাঁদে বসে চরকায় সুতো কাটেন - এই গল্প আমাদের জানা সেই ছোটবেলাতেই। আর তখন থেকেই আমাদের চাঁদ সম্পর্কে নানা কৌতুহল। এ কৌতুহল দীর্ঘ সময়ের। মানুষ যখন আগুনের ব্যবহার শেখে তখন থেকেই গুহার ভিতরে আগুন জ্বেলে তার পাশে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবতো মিট মিট করে জ্বলতে থাকা তারাদের কথা, ছুটন্ত উল্কাপিন্ড বা মায়াবী চাঁদের কথা। চাঁদ পৃধিবীর একমাত্র উপগ্রহ। মহাকাশ অভিযানের প্রথম থেকেই মানুষের লক্ষ্য ছিল চাঁদে অবতরণ করে এক রহস্যের দ্বার উন্মোচন করা। ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই তারিখে (বাংলাদেশ সময় ২১ জুলাই) মানুষ প্রথমবারের মত চাঁদের মাটিতে অবতরণ করে। এই দিনটিতেই সূচিত হয়েছে মহাকাশ জয়ের নতুন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার এক বিরাট পদক্ষেপ। এ বছর চাঁদে অবতরণের ৪১ বছর পূর্তি হলো। আমরা মানব ইতিহাসের এই অবিস্মরনীয় ঘটনাকে গর্বের সাথে স্মরণ করছি।
চাঁদ সৃষ্টির রহস্য নিয়ে এ যাবৎ অনেক মতবাদই প্রচলিত রয়েছে। প্রথমত, ১৮৮০ সালে স্যার জর্জ ডারউইন কল্পনা করেন যে দূর অতীতে পৃথিবীর এক অংশ থেকে চাঁদের জন্ম। তখন পৃধিবী ছিল বর্তুলাকার এক ঘূর্ণায়মান গলিত বস্তু, যা সূর্যের আকর্ষনে দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। কারণ, দেখা গেছে চাঁদের ঘনত্ব পৃথিবীর উপরিভাগের ঘনত্বের প্রায় সমান। দ্বিতীয়ত, ১৯৫৫ সালে গের্ষ্টেনকর্ণ ব্যাখ্যা করেন - চাঁদ সৌরজগতের অন্যত্র তৈরি হয়েছিল। কোন এক সময়ে এটি পৃধিবীর আওতার মধ্যে চলে আসে এবং সেই থেকে আজোও রয়ে গেছে। তৃতীয়ত, যে কুন্ডলীত, ঘূর্ণায়মান ধূলি ও গ্যাসপিন্ড থেকে সূর্যের জন্ম সেই সৌর নীহারিকার অসংখ্য পাথর কনার সমন্বয়ে প্রায় ৪৫০ থেকে ৪৫৫ কোটি বছর পূর্বে পৃথিবীর সৃষ্টি। তখন পৃথিবীর চারপাশে শনিগ্রহের মত বলয় ছিল। এই বলয়ের বড় পিন্ডগুলো ধীরে ধীরে জড়ো হয়ে উপগ্রহ চাঁদে পরিণত হয়।
মহাকাশে চাঁদ হলো আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী। চাঁদের কক্ষপথ উপবৃত্তাকার বলে পৃথিবী থেকে এর দূরত্বের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে। চাঁদের নিজ অক্ষের উপর আবর্তন কাল ও পৃথিবীকে প্রদক্ষিণকাল সমান বলে আমরা চাঁদের একটি পিঠকেই দেখতে পাই। পৃথিবীর সাপেক্ষে কক্ষ পরিভ্রমনকালে চাঁদ ৫.১৫ ডিগ্রী হেলে যায় বলে প্রতি মাসে আমরা চাঁদের দৃশ্যমান পিঠের ৫৯% দেখতে পাই। পূর্ণিমার সময় যখন পৃথিবীর ছায়া চন্দ্রপৃষ্ঠে পড়ে তখন চন্দ্রগ্রহণ ঘটে থাকে। প্রতি বছর ২/৩ টা চন্দ্রগ্রহণ ঘটে। পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ প্রায় ১ ঘন্টা ৪০ মিনিট স্থায়ী হয়।
চাঁদের পৃষ্ঠ আপাতদৃষ্টিতে সমতল মনে হলেও মোটেই তা নয়। এখানে দু’মাইলেরও অধিক উঁচু পাহাড় আছে। আর আছে বড় বড় জ্বালামুখ, যার কোনটার ব্যস ৬০-৭০ মাইল পর্যন-। চাঁদের সমতল ভূমিকে বলা হয় ‘মারিয়া’(Maria), যার অর্থ সমুদ্র। প্রাচীন জ্যোতির্বিদরা তাদের স্বল্প বিবর্ধনের দূরবীন দিয়ে পর্যবেক্ষণ করার সময় চাঁদের সমতল ভূমিকে সমুদ্র বলে ভেবেছিল বলে এই নামকরণ। চাঁদের পৃষ্ঠের বৃত্তাকার ও উচুঁ দেয়াল ঘেরা গর্তকে ক্র্যাটার বলে। মাঝে মাঝে কেন্দ্রে দু’একটা চূড়া থাকে। এগুলো তৈরি হয়েছে চাঁদের তরুণ বয়সে উল্কাপাতের ফলে। চন্দ্র ক্র্যাটারদের অধিকাংশই ২০ কি.মি. ব্যাসের কম। ১৬৫০ খ্রিষ্টাব্দে জ্যোতির্বিদ রিসিওলি সর্বপ্রথম চন্দ্রপৃষ্ঠের মানচিত্র প্রনয়ণ করেন।‘এ্যাপোলো’ প্রজেক্টের মাধ্যমেই শুরু হয় চাঁদে অভিযানের প্রস’তি। কিন’ শুরুতেই বিপত্তি। ১৯৬৭ সালের জানুয়ারিতে ‘এ্যাপোলো’ প্রজেক্টের এক দূর্ঘটনায় প্রাণ হারান তিন নভোচারী। তাই বলে থেমে থাকেনি এই অভিযান। এরপর ‘এ্যাপোলো ৮’ এ চড়ে তিনজন নভোচারীর একটি দল চাঁদের প্রায় ৬০ মাইল দূর থেকে চাঁদকে ঘুরে পৃথিবীতে ফিরে আসেন। ‘এ্যাপোলো ১০’ এর অভিযানকে ধরা হয় মূল অভিযানের ড্রেস রিহার্সেল হিসেবে। এরপর এল সেই অবিস্মরণীয় ২০ জুলাই, ১৯৬৯। আমেরিকার কেপ কেনেডি থেকে সকাল ৯ টা ৩২ মিনিটে তিন মহাকাশ অভিযাত্রী নীল আর্মস্ট্রং, এডউইন অলড্রিন এবং মাইকেল কলিন্স-কে নিয়ে চাঁদের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমায় ‘এ্যাপোলো ১১’। ১৬ জুলাই রওনা হয়ে তারা চাঁদে পৌঁছান ২০ জুলাই (বাংলাদেশ তারিখ ২১ জুলাই)।
চারটি প্রধান অংশ ছিল এই মহাকাশযানে: ১) ফ্রিস্টেজ রকেট স্যাটার্ণ ৫ (তিনটি রকেট নিয়ে তৈরি) ২)সার্ভিস মডিউল - রকেট উঞ্জিন ও জ্বালানীর জায়গা ৩) লুনার মডিউল ‘ঈগল’ - বিশেষভাবে তৈরি ছোট গাড়ি, যা চাঁদের বুকে চলার উপযোগী ৪) কম্যান্ড মডিউল ও কলম্বিয়া - মহাকাশযানের মূল নিয়ন্ত্রক অংশ।
চাঁদে পৌঁছবার ৬২ থেকে ৭৫ মাইল দূর থেকেই আর্মস্ট্রং এবং অলড্রিন লুনার মডিউলে প্রবেশ করেন। কম্যান্ড মডিউল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এটি চাঁদে নামতে শুরু করে। চাঁদের পৃষ্ঠ অসমান হওয়ায় চাঁদের আকাশে সমান্তরালভাবে একে চালিয়ে নিয়ে সুবিধেমত ইতস্তত নুড়ি ছড়ানো একটি জায়গায় নামানো হয়। এলাকাটির নাম Mare Tranquilliyatis। এর প্রায় ৭ ঘন্টা পরে আর্মস্ট্রং প্রথম মানব হিসেবে পা রাখেন চাঁদের মাটিতে। জয় হয় এক স্বপ্নের। আর্মস্ট্রং এবং অলড্রিন চাঁদের বুকে সময় কাটান ২ ঘন্টা ১৩ মিনিট। এ সময় তারা চাঁদের বুকে পরীক্ষা চালানোর নানা যন্ত্রপাতি স্থাপন এবং চাঁদের পাথর সংগ্রহ করেন। অভিযানের শেষাংশে তারা ফিরে গেলেন লুনার মডিউলে। এটি চাঁদের বুক থেকে উঠে এসে কম্যান্ড মডিউলের সাথে যুক্ত হলো। আর্মস্ট্রং এবং অলড্রিন কম্যান্ড মডিউলে চলে এলেন এবং লুনার মডিউলকে চেড়ে দেয়া হয় মহাশূণ্যে।
পরবর্তীতে রকেট চাঁদের মহাকর্ষ কাটিয়ে পৃথিবীর দিকে যাত্রা শুরু করে। ২৪ জুলাই পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে প্রবেশের ঠিক আগে সার্ভিস মডিউল পরিত্যক্ত হল। ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩ কি.মি. উঁচুতে মহাকাশযান থেকে তিনিট বিরাট প্যারাসুট নামিয়ে দেয়া হলো। কম্যান্ড মডিউল নিরাপদে প্রশান্ত মহাসাগরে অবতরণ করে। লেখা হয় মহাকাশ গবেষনার নতুন ইতিহাস। কর্তৃত্ব শুরু হয় সৌরজগতের বাইরে বহির্জাগতিক সীমানায়। নীল আর্মস্ট্রং এব ভাষায়: One small step for man, one giant leap for mankind।
বায়ু শূণ্য ও প্রানহীন পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহটির ব্যাস |
৩,৪৭৬ কি.মি. |
পৃথিবী থেকে চাঁদের গড় দূরত্ব |
৩,৮৪,৪০১ কি.মি. |
সর্বনিম্ম দূরত্ব |
৩,৬৩,২৯৭ কি.মি. |
সর্বোচ্চ দূরত্ব |
৪,০৫,৫০৫ কি.মি. |
কক্ষীয় পর্যায় |
২৭ দিন ৭ ঘন্টা ৪৩ মিনিট ১২ সেকেন্ড |
ঘূর্ণন কাল |
২৭.৩২ দিন |
চান্দ্র মাস |
২৯ দিন ১২ ঘন্টা ৪৪ মিনিট ৩ সেকেন্ড |
ভর |
৭.৩৫ ক্ম ১০২৫ গ্রাম |
ঘনত্ব |
৩.৩৪ গ্রাম/সিসি. |
অভিকর্ষ |
০.১৬৫ ম |
পৃষ্ঠ তাপমাত্রা |
দিনে ৪০০ ডিগ্রী কেলভিন এবং রাতে ১০০ ডিগ্রী কেলভিন |