সর্বশেষ:
ঢাকা, মে ১৪, ২০২৪, ৩০ বৈশাখ ১৪৩১

cosmicculture.science: বিজ্ঞানকে জানতে ও জানাতে
শনিবার ● ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১১
প্রথম পাতা » বিজ্ঞান নিবন্ধ: মুক্তবুদ্ধি চর্চা » জ্যোতিষ বনাম বিজ্ঞান
প্রথম পাতা » বিজ্ঞান নিবন্ধ: মুক্তবুদ্ধি চর্চা » জ্যোতিষ বনাম বিজ্ঞান
১৭৩৯ বার পঠিত
শনিবার ● ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১১
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

জ্যোতিষ বনাম বিজ্ঞান

মানুষ তার নিজের ভাগ্য গড়ে নেয়:- ছেলেমেয়েরা আজও পরীক্ষায় খাতায় এই বিষয়ে রচনা লিখছে, অথচ রাস্তাঘাটে বিজ্ঞাপনে, পথচলতি কথাবার্তায়, বাড়িতে আত্মীয়স্বজনের মধ্যে তারা দেখছে কিভাবে ঠিকুজি-কোষ্ঠী, ভাগ্য, গ্রহরত্নের প্রতি অন্ধ-নির্ভরতা দিব্যি বেঁচে আছে। একটি কিশোর এভাবেই বড় হচ্ছে এক বিভ্রান্তিকর বাতাসে। বৈজ্ঞানিক বিচারের মধ্যে দিয়ে ভুয়া বিশ্বাস আর পিছিয়ে পড়া বিভ্রান্তকর ধারণাকে চিনিয়ে দেওয়া আমাদের উদ্দেশ্য, কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে নিছক আক্রমন করাই আমাদের উদ্দেশ্য নয়। যে নিম্ন আয়ের মানুষটি শেকড়, পাথর, অষ্টধাতু বা তাবিজ-কবচ বিক্রি করে কিংবা হাত দেখে আধপেটা খেয়ে বাঁচে তার ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্থ হবে ঠিকই কিন্তু অধিকাংশ মানুষের সুস্থ অগ্রগতির স্বার্থে এদের বিপর্যস্থ হওয়া তো অবধারিতই!
চলতি দৈনিক পত্রিকা ও সাময়িকীতে প্রকাশিত ‘রাশিফল’, ‘আজকের দিনটি কেমন যাব’, ‘সপ্তাহ কেমন যাব’ ইত্যাদি মানবমনকে পঙ্গু করে। কায়েমী মহলের এই ক্ষতিকর কার্যকলাপের বিরুদ্ধেও বিজ্ঞানমনস্কতার প্রতিরোধ দরকার। তবে রাগ-আক্রোশে গলা ফাটিয়ে নয়, ব্যাপক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমেই সে প্রত্যাঘাত কার্যকর হতে পারে। আর এ সবের জন্য জন্যই প্রাথমিকভাবে প্রয়োজন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির, প্রয়োজন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির উপর নির্ভেজাল নির্ভরতা। বহুলোক জেনেশুনে রত্ন-আংটি-কবচ-বালা পরে থাকেন বিশেষ মানসিক অবস্থায়। হতাশাক্লিষ্ট, সমস্যা জর্জরিত, অসহায় মানব মনের অবলম্বন যখন হয় জ্যোতিষ, তখন সেই ব্যক্তিকে যুক্তি-তর্ক-জ্ঞান দিয়ে মুক্তির পথ দেখানো যায় না। যে বাস্তব অবস্থার জন্য তার স্বাভাবিক সাম্য হারিয়েছে, সেই অবস্থার পরিবর্তন ছাড়া পর্যদুস্থ মনকে সুসস্থর করা বোধহয় সম্ভব নয়। বিপুল সংখ্যক মানুষ স্বাভাবিক অবস্থাতেই নিরাপত্তাহীন জীবনে সহজে পরিত্রান পাওয়ার লোভে কিংবা হঠাৎ স্বাচ্ছন্দ্য লাভের প্রত্যাশায় জ্যোতীষ জাতীয় গুপ্তবিদ্যার কাছে আত্মসমর্পণ করে। ফল দাঁড়ায় - অগণিত দূর্বলচিত্ত, কর্মোদ্যোগহীন, আত্মবিশ্বাস বর্জিত মানুষে ঠাসা এক সমাজ। জো্যতিষ চর্চার কার্যকারিতা দাঁড়িয়ে আছে জ্যোতিষীর প্রতি মক্কেলের ভরসার মাত্রার উপর। জ্যোতীষবিদ্যা যদি তার প্রাচীন তত্ত্ব আর এই মনস্তাত্তিক ভূমিকাটার দাবি নিয়েই আত্মতৃপ্ত থাকতো তাহলে কিছু বলার ছিল না। কিন্তু এই বিদ্যা বিজ্ঞানের প্রত্যক্ষ বিরোধী হয়েও আবার বিজ্ঞানেরই সমর্থন খুঁজতে চায়, বিজ্ঞানেরই খোলস গায়ে চড়াতে চায় আপন মর্যাদা প্রতিষ্ঠার স্বার্থে। গোল বাঁধে তখনই - জটিল চক্রটা জটিলতর হয়। বর্তমান অগ্রসরমান সভ্যতার প্রেক্ষাপটে জ্যোতিষবিদ্যার অপবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার বিপরীতে যৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি উত্তরণের নিমিত্তেই লেখাটি .. ..

সাধারণ মানুষকে অতীত গ্লানি থেকে মুক্তি দিতে গ্রহ-নক্ষত্র বা অন্য কোন কিছুর ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিয়ে, বর্তমানের জন্য প্রশংসা আর ভবিষ্যতের জন্য আশা দিয়ে জ্যোতিষীরা তাদের মক্কেলদের প্রতারিত করেন।প্রাচীনকালের মানুষের জগৎ-চিন্তা ও জীব বোধ ছিল অস্পষ্ট, কখনোবা ভ্রান্ত। বিজ্ঞান ও মানবসভ্যতা ছিল অনুন্নত। সমকালীন সমাজের বিজ্ঞান এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা তাকে কতটা দিতে পারে সে বিষয়ে বিশেষ ধারণা ছিল না। শত সহস্র বছরের পরীক্ষা-নিরীক্ষা-অভিজ্ঞতার সঠিক সারাংশ নিয়ে গড়ে উঠেছে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা। অসার ও ভ্রান্ত ধারণা, তথ্য ইত্যাদি বিজ্ঞানে বর্জিত হলেও মানুষের মনে আজও তার যথেষ্ট প্রভাব রয়ে গেছে। আশা-আকাঙ্খা কামনা-বাসনা চরিতার্থ করবার আশায় মানুষ আজও নানা ক্রিয়াকর্ম করে থাকে যার সবগুলোই বাস্তবসম্মত নয়। অসংখ্য কুসংস্কারের মধ্যে পঞ্জিকা মেনে জীবন চালানো, কোষ্ঠী ও ভাগ্যবিচার, গ্রহরত্ন ধারণ ইত্যাদও পড়ে কিনা - সে সবই বিচার বিশ্লেষণ করে দেখা উচিত। এসবের মূলে রয়েছে ফলিত জ্যোতিষ বা অ্যাস্ট্রোলজি (Astrology)। বহু প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত থাকলেও এবং অনেক হিসেব নিকেশ আঁক-জোক থাকলেও জ্যোতিষ বা অ্যাস্ট্রোলজি বরাবরই জ্যোতির্বিজ্ঞান বা অ্যাস্ট্রোনমি (Astronomy) থেকে ভিন্ন। জ্যোতির্বিজ্ঞান বা অ্যাস্ট্রোনমির ভিত্তিই হলো যন্ত্রপাতিযোগে বাস্তব পর্যবেক্ষণ, পরিমাণ ও গাণিতিক প্রক্রিয়ার গৃহীত সিদ্ধান্ত। এসব থেকে পাওয়া তথ্যাবলী সবখানেই সঠিক বলে প্রমানিত হয়েছে। মহাকাশ যুগের আধুনিক বিজ্ঞান জ্যোতির্বিদ্যাকে আরও পরিশুদ্ধ, উন্নত, ব্যাপক ও জ্ঞানগর্ভ করে তুলেছে। জ্যোতিষীরা মনে করেন মানুষের স্বভাব-চরিত্র, আয়ু, ভাগ্য ইত্যাদি ভালো মন্দ সবকিছূ নির্ভর করে তার জন্মলগ্নের গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থানের উপর। আবার একই সঙ্গে জন্ম মুহূর্তের প্রতিকূল গ্রহ-নক্ষত্রের অশুভ প্রভাব কাটিয়ে তাবিজ-কবচ-ঝাড়ফুঁকের মাধ্যমে সৌভাগ্য বৃদ্ধির বিধানও তারা দিয়ে থাকেন (আশ্চর্য স্ব-বিরোধিতা!)।
জ্যোতিষচর্চা, ব্যক্তি ও রাষ্ট্রজীবনে জ্যোতিষীদের প্রভাব অন্যান্য দেশের মত আমাদের দেশেও অতি প্রাচীনকাল থেকেই রয়েছে। জনসাধারণের জ্যোতিষের প্রতি এই আস্থা কখনোই কমেনি বরং বেড়েই চলেছে। বেড়েছে জ্যোতিষীদের চেম্বার, জমজমাট হয়েছে তাবিজ-কবচ-মনিরত্ন ব্যবসায়ীদের কারবার (দৈনিক পত্রিকার পাতায় হরহামেশাই দেখা যায় এদের চোখ ধাঁধানো বিজ্ঞাপন। অনেক বিজ্ঞান পড়া - গবেষণা করা লোকেরাও জ্যোতিষের পক্ষে যুক্তি-তথ্য-উদাহরণ উপস্থাপন করে এর ব্যাপকতর প্রসারের চেষ্টায় মেতেছে। ব্যাপারগুলো জটিল এবং বিতর্কিত - বিজ্ঞানের আলোয় এর পর্যালোচনা দরকার। বিজ্ঞানের সত্যতা, প্রমান্য, শক্তি, ব্যাপ্তি আজ সর্বজনস্বীকৃত। বিজ্ঞান কখনোই প্রকাশ করে না যে সবকিছু জানা সম্ভব হয়ে গেছে বরং বিজ্ঞান সর্বদাই অস্পষ্টতা থেকে স্পষ্টতায় যেতে চায়। একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই বিজ্ঞান তার সত্য উপলব্ধির ভিত্তিকে আরও দৃঢ় করে। জ্যোতিষবিদ্যাকে বড় বড় বিজ্ঞানী ও বহু প্রাজ্ঞ সচেতন মানুষ একে ভ্রান্ত ও বিভ্রান্তকর বলে অভিহিত করেছেন। এটি এখন সর্বত্রই ভূয়া বিজ্ঞান বা বলে পরিচিত। তথাপি জ্যোতিষীদের দাপট এক চুলও কমেনি। সুতরাং এটা বোঝা এবং ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন - কেন সুপ্রাচীন কাল থেকে বর্তমান পৃথিবীতেও এর এত প্রচলন। প্রাচীনকালে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই মানুষ তার কৃষিকর্ম, নৌ-চালনা, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ইত্যাদির তাগিদে পৃথিবী, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করেছে। তখন জ্যোতিষবিদ্যা এবং জ্যোতির্বিদ্যার মধ্যে কোন পার্থক্য ছিল না। কারণ তখন কোন টেলিস্কোপ ছিল না, গণিত ও অন্যান্য বিজ্ঞানের উন্নতিও হয়নি। পরবর্তীতে ইউরোপীয় নবজাগরনের কালে (রেঁনেসা) নিকোলাস কোপার্নিকাস-জিওর্দানো ব্রুনো-গ্যালিলিও গ্যালিলি-টাইকো ব্রাহে-জোহান্স কেপলার-নিউটনের হাত ধরে পরীক্ষা গবেষণালব্ধ জ্ঞানের সাহায্যে অস্পষ্ট-অসম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণাগুলো পরিমার্জিত ও পরিশোধিত হয়ে বর্তমান জ্যোতির্বিদ্যার রূপ নিয়েছে। অ্যাপোলোনিয়াস, হিপার্কাস, আর্যভট্ট, ভাস্করের জ্যোতিষবিদ্যায় গণনা থাকলেও তা বিজ্ঞান হয়ে উঠতে পারেনি। পুরাতনকালের সেইসব অস্পষ্টবোধ বা ভ্রান্ত ধারণা আজকের যুগে অচল এমনকি হাস্যকর মনে হলেও সভ্যতা ও বিজ্ঞানের উন্নতিতে এদেরও যথেষ্ট অবদান ছিল। আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে সুমেরীয়, আক্কাদ, ব্যাবিলন, মিশর, হরপ্পা প্রভৃতি স্থানে সভ্যতার কেন্দ্রগুলি গড়ে উঠে যেগুলি ছিল রাজা ও পুরোহিত শাষিত। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রয়োজনে সে স্থানের মানুষেরা শিখলো মাপজোঁক, গণনা ও সাধারণ হিসাব। কিন্তু তখন ঘড়ি-ক্যালেন্ডার ছিল না, মাস-ঋতু-বছরের কোন ধারণা ছিল না। প্রকৃতির উপর মানুষ ছিল অনেকাংশে নির্ভরশীল। ক্রমে মানুষের দৃষ্টি পড়ল আকাশের চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-নক্ষত্রের নিয়মবদ্ধ চলাচলের দিকে। এসব থেকেই আবিষকৃত হল সময় গণনা, ক্যালেন্ডার। নীলনদের বন্যা সূর্যের অবস্থানের সাথে যুক্ত থাকায় মিশরে সৌর ক্যালেন্ডার আবিষ্কৃত হয়, অন্যত্র চন্দ্র কলার হ্রাস-বৃদ্ধিকে ভিত্তি করে চন্দ্র ক্যালেন্ডার প্রচলিত হয়। তাই চাঁদ ও তিথিগুলিকে কেন্দ্র করে নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠান গড়ে ওঠে, যার অবশেষ এখনো চলছে আমাদের দেশে - অমাবস্যা, পূর্ণিমা, একাদশী প্রভৃতির সঙ্গে সাধারণ মানুষের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় জীবন আজও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। স্বাভাবিক বাস্তব বুদ্ধির বলে প্রায় সব সভ্যতার ঊষাকালেই মানুষ বুঝতে পেরেছিল কৃষিকাজ, বৃষ্টিপাত, বায়ুপ্রবাহ প্রভৃতির জন্য সূর্যের গুরুত্বই বেশি। তাই চাঁদের চেয়ে সূর্য বন্দনা বেশি গুরুত্ব পায়। সুমেরীয়, ব্যাবিলন প্রভৃতি স্থানে মিশরের মত সৌর ক্যালেন্ডারের প্রয়োজনীয়তা ততোটা বেশি না থাকায় সেখানে পুরোহিতেরা চন্দ্র ও সৌরবছরের ভিতর সামঞ্জস্য রাখার চেষ্টা করেন। যদিও শেষ অবধি তারা সফল হননি। একটি বৃত্তকে ৩৬০ ডিগ্রীতে ভাগ করা, দিনকে ২৪ ঘন্টায়, ঘন্টা ও মিনিটকে ৬০ ভাগ করা ইত্যাদি সুমেরীয়তেই হয়। ৭৮৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকেই সুশৃঙ্খল ও ধারাবাহিকভাবে সমস্ত গ্রহগুলোর একটি তালিকা প্রণয়নই সম্ভবত ব্যাবিলনীয়দের শ্রেষ্ট কীর্তি। প্রায় ৯০০ বছর পর টলেমি এই তালিকা ব্যবহার করে গণিত সহযোগে বিশ্বের একটি গঠন পরিকল্পনা করেন যা ষোড়শ শতাব্দীর কোপার্নিকাস পর্যন্ত প্রায় সর্বজনগ্রাহ্য ছিল। গ্যালিলিও কর্তৃক টেলিস্কোপ আবিষ্কারের (১৬০৮ খ্রিষ্টাব্দ) পূর্ব পর্যন্ত আকাশ ও জ্যোতিষ্কমন্ডলী সম্বন্ধে নতুনতর ও উন্নততর তথ্য ও জ্ঞান আহরণ করা সম্ভব ছিল না। সুতরাং ষোড়শ শতাব্দী অবধি পুরাতন জ্ঞানের সুসংবদ্ধ গ্রন্থনা ও ভাগ্যগণনার প্রসারই ঘটতে থাকল।
আধুনিক সৌরকেন্দ্রিক ব্রক্ষ্মান্ড পরিকল্পনার জন্মদাতা নিকোলাস কোপার্নিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩)। তিনি শুধু জ্যোতির্বিজ্ঞানেই বিপ্লব আনেননি, তাঁর আবিষ্কার মধ্যযুগের অবসান ঘটিয়ে আধুনিক সমাজ ও বিজ্ঞানের সূচনা করেছিল। এর আগে পর্যন্ত যে বিশ্ব-তত্ত্ব প্রচলিত ছিল, তাতে পৃথিবী ছিল মহাবিশ্ব কেন্দ্র। আলেক্সান্দ্রিয়ার টলেমি প্রাচীন জ্ঞানাবলী গ্রন্থনা করে গণিত সহযোগে এই বিশ্বতত্ত্বটি দেন আনুমানিক ১৪০ খ্রিষ্টাব্দে। গ্যালিলিও-র (১৫৬৪-১৬৪২) আগে দূরবীক্ষণ যন্ত্র না থাকায় গ্রহ-নক্ষত্র সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান ছিল খুবই সীমিত, অস্পষ্ট। আধুনিক বিজ্ঞানের বিপরীতে জ্যোতিষবিদ্যার পুঁথিগুলো পুরাতন, বাতিলযোগ্য। স্বল্পজ্ঞানী ও ভুয়াজ্ঞানী হওয়া সত্ত্বেও আজও গণৎকাররা সেইসব অচল বিদ্যার আধারদেরই প্রামান্য বলে প্রচার করে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। গ্রহ মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করে - এমনটাই দাবি ওইসব গণকদের। কিন্তু পরবর্তীকালে আবিষ্কৃত ইউরেনাস, নেপচুন, প্লুটো গ্রহগুলো জ্যোতিষীদের হিসাবে নেই। অন্য জ্যোতিষ্করা, এমনকি এদের চেয়ে বহুদূরের নক্ষত্ররা যদি মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করতে পারে, তবে এরা বাদ যাবে কেন? অপরদিকে আদিম মানুষের কল্পনাজাত রাহু ও কেতু নামক স্বর্গীয় দুই দানবের প্রভাবও এরা গণনায় আনেন। যুক্তিতে মুশকিলে পড়ে গিয়ে পরবর্তী জ্যোতিষীরা রাহু ও কেতুকে অদৃশ্য অন্ধকার গ্রহ বলে চালাতে চেষ্টা করেন। মজার কথা হল, এদের কোন বাস্তব অস্তিত্ব না থাকা সত্ত্বেও এরা নাকি আমাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে। আর পুরাতন জ্যোতিষীরা জানতেনই না যে, সূর্য গ্রহ নয়, একটি নক্ষত্র। যে জন্ম সময়টি সমস্ত গণনার ভিত্তি, সেই জন্ম সময় নিয়ে জ্যোতিষীদের মধ্যেই মতভেদ আছে। কেউ কেউ মাতৃগর্ভ থেকে বেরিয়ে আসার সময়কেই জন্মলগ্ন ধরেন, কেউ বা নাড়ি কাটার সময়টাকে। অথচ শিশু ভ্রুণের জন্ম হয়েছে এর প্রায় ২৮০ তিন আগে গর্ভধারণের কাল থেকে। প্রাচীন ব্যাবিলন ও গ্রীস দেশে এই ভিত্তিতেই কোষ্ঠী রচনা করা হতো। একটা বড় হাসপাতালে একই সময়ে অনেক শিশু জন্ম নিতে পারে, তাদের ভাগ্য কিন্তু কখনোই এক হয় না। বিভিন্ন পরিবেশ, পারিবারিক অবস্থা ও শিক্ষাদীক্ষার প্রভাবে তাদের দেহ, স্বভাব চরিত্র, ভাগ্য নির্ধারিত হয়। জন্মলগ্নের ভিত্তিতে জ্যোতিষী রচিত কোষ্ঠীতে আকাশের যে চিত্র থাকে তাও যথার্থ ও সঠিক নয়। সূর্য বা অন্যান্য জ্যোতিষ্ক থেকে আলো আসতে নির্দিষ্ট কিছু সময় লাগে (আলোর বেগ সেকেন্ডে ১ লাখ ৮৬ হাজার মাইল)। জ্যোতিষী পন্ডিতেরা কেউই জানতেন না যে, ১২ টি রাশিচক্রে এমন কোন নক্ষত্রও নেই যা থেকে আলো আসতে সাড়ে চার বছরের কম সময় লাগে। কোন নক্ষত্র যদি আজ বিস্ফোরিত হয়ে ধ্বংস হয়েও যায় তা জানতেও আমাদের শত শত বছর লেগে যাবে (কারণ নক্ষত্রেরা বহু বহু আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত)। জ্যোতিষীরা এসব ব্যাপারে আদৌ জানেন কি? অতীতের অসাড়, ভুল, অচল জ্ঞানরাশির আবর্জনাকে কাজে লাগিয়ে সাধারণ মানুষের সরলতা, মানসিক দূর্বলতাকে ব্যবহার করে জ্যোতিষী গণক সেজে আজও লোক ঠকিয়ে চলেছে। ষোড়শ শতকের কোপার্নিকাসের পর বড় বড় জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা কেউই জ্যোতিষ গণনা করেন নি। জোহান্স কেপলার এই ব্যবসা করলে কপর্দকহীন হযে মরতেন না।
প্রায় নব্বই বছর আগে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন ‘যদি নক্ষত্র আমাদের জীবনে প্রভাব ফেলে ফেলুক, তাতে কিছূ ক্ষতি নেই। যদি কোন নক্ষত্র আমাদের বিব্রত করেও তাতেও কিছু যায় আসে না। আপনারা এটা জানুন যে, জ্যোতিষে বিশ্বাস সাধারণত একটি দূর্বল মনের লক্ষণ। সুতরাং মনে এই দূর্বলতা এনেই আমাদের উচিত ডাক্তার দেখিয়ে ভালোভাবে খাওয়া আর বিশ্রাম করা।’ তবু কোষ্ঠীরচনা, ভাগ্যগণনা, তাবিজ-কবচ, পাতর ধারণ চলছে ব্যাপকভাবে। কিন্তু কেন এইসব? সাধারণ মানুষ যারা জীবন সংগ্রামে জর্জর, অথচ জীবন পিয়াসী, যাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান সীমিত, যাদের যু্‌ক্তি ও বুদ্ধি দিয়ে বিচার করার ক্ষমতা সীমিত, তারা বহুলাংশে প্রচলিত সংস্কার ও আবেগ দ্বারাই জীবনে পরিচালিত হন। জ্যোতিষীরা বেশ লোকের মন বুঝে কথা বলতে পারেন। দূর্বল লোকেরা অনিশ্চিত এমনকি মিথ্যা হলেও নিজের সম্বন্ধে ভালো কথা, আশার কথা শুনতে চান। সাধারণ মানুষকে অতীত গ্লানি থেকে মুক্তি দিতে গ্রহ-নক্ষত্র বা অন্য কোন কিছুর ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিয়ে, বর্তমানের জন্য প্রশংসা আর ভবিষ্যতের জন্য আশা দিয়ে জ্যোতিষীরা তাদের মক্কেলদের প্রতারিত করেন। সঙ্কটে বা নৈরাশ্যে পড়লে দৈব বা গ্রহ-নক্ষত্রের অনুগ্রহ মানুষকে বাঁচাতে পারবে না। মানুষকে বুঝতে হবে যে, মানুষই তার ভাগ্য গড়ে অথবা তাদের মতো আর এক শ্রেণীর মানুষ তাদের জন্য দুঃখ ও দুর্ভাগ্য বয়ে আনে। যু্‌ক্তি, বুদ্ধি ও বাস্তব অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমবেত প্রচেষ্টার মধ্যে দিয়েই মানুষকে সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে হবে। সেজন্য আত্মবিশ্বাস, জ্ঞান ও কর্মোদ্যোগই মূলমন্ত্র হওয়া উচিত।

 

মূল: উৎস মানুষ, মনীন্দ্রনারায়ণ মজুমদার, অশোক বন্দোপাধ্যায়





আর্কাইভ

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)
মহাবিশ্বের প্রারম্ভিক অবস্থার খোঁজেজেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের প্রথম রঙীন ছবি প্রকাশ
ব্ল্যাকহোল থেকে আলোকরশ্মির নির্গমন! পূর্ণতা মিলল আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের
প্রথম চন্দ্রাভিযানের নভোচারী মাইকেল কলিন্স এর জীবনাবসান
মঙ্গলে ইনজেনুইটি’র নতুন সাফল্য
শুক্র গ্রহে প্রাণের সম্ভাব্য নির্দেশকের সন্ধান লাভ
আফ্রিকায় ৫০ বছর পরে নতুনভাবে হস্তিছুঁচোর দেখা মিলল
বামন গ্রহ সেরেসের পৃষ্ঠের উজ্জ্বলতার কারণ লবণাক্ত জল
রাতের আকাশে নিওওয়াইস ধূমকেতুর বর্ণিল ছটা,আবার দেখা মিলবে ৬,৭৬৭ বছর পরে!
বিশ্ব পরিবেশ দিবস ২০২০
মহাকাশে পদার্পণের নতুন ইতিহাস নাসার দুই নভোচারী নিয়ে স্পেসএক্স রকেটের মহাকাশে যাত্রা